সাইফুল ইসলাম, টাঙ্গাইল প্রতিনিধিঃ টাঙ্গাইলের মধুপুরে জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণার নামে স্থানীয় আদিবাসীদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বুধবার (২৭ জানুয়ারি) শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আদিবাসী ফোরামের ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক রিপন চন্দ্র বানাই এর সঞ্চালনায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামসহ ২৩ টি সংগঠনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে সংহতি বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস, ঢাবির ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৌরভ সিকদার, নাট্যকার মামুনুর রশীদ, মানবাধিকার কর্মী জাকির হোসেন, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিন্দ্র নাথ সরকার।
মানববন্ধনের আদিবাসী ফোরামের ছাত্র ও যুব বিষয়ক সম্পাদক রিপন চন্দ্র বান লিখিত বক্তব্যে বলেন, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি গত বছরের ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে দখলদারদের তালিকা তৈরী করে ৩০ জানুয়ারীর মধ্যে উচ্ছেদ নোটিশ দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়টিতে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
তিনি আরও বলেন, জাতিসংঘসহ সারা পুথিবী জানে আদিবাসী জনগণ ও বনভূমি একে অন্যের পরিপূরক। পৃথিবীর জনসংখ্যার ৫ ভাগ আদিবাসী কিন্তু পুথিবীর ৮০ ভাগ জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করেন। অবিলম্বে মধুপুর বনের আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ও চিরায়ত ভূমির মালিকানার স্বীকৃতি দেয়া এবং এর জন্য ত্রি-দলীয় জরিপের মাধ্যমে আদিবাসীদের ভূমি চিহ্নিত করা, আদিবাসীদের ভূমিতে সংরক্ষিত বন, জাতীয় উদ্যান, ইকোপার্ক জাতীয় প্রকল্প বাতিল করা এবং কোনো আদিবাসী জমি এই সব প্রকল্পের আওতায় না আনা, সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করাসহ সাত দফা দাবী জানাই।
সংহতি জানিয়ে ঢাবি অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, একথা খুব হলফ করে বলা যেতে পারে যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বন ধ্বংস করেছে বনবিভাগ। বড় বড় টাকার মালিকরা তাদের কালো টাকায় আদিবাসী অঞ্চলে রিসোর্ট তৈরী করছে এবং বছরে একবার গিয়ে অবকাশ যাপন করছে। বাংলাদেশের আদিবাসীরায় দেশের বনভূমির প্রধান সংরক্ষক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ও সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের আজিজুর রহমান বলেন, যে আদিবাসীরা মধুপুর অঞ্চলে হাজার বছর ধরে বসবাস করে আসছে তাদেরকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করার পায়তারা চলছে। তাদেরকে বন উজাড়কারী, খাল দখলকারী বলে বদমাইশ ও লুঠেরাদের সাথে এক কাতারে ফেলা হচ্ছে। এটা মুক্তিযুদ্ধের পরিপন্থি।আদিবাসীদেরকে অবৈধ বলার অধিকার বাংলাদেশের কারোর নেই। অবিলম্বে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় প্রণীয় আদেশ প্রত্যাহারেরও আহ্বান জানাই।
ঢাবির অধ্যাপক ড. সৌরভ সিকদার বলেন, আমরা সারা পৃথিবীতে যখন দেখছি আদিবাসীদের বৈচিত্র্যকে ধরে রাখতে প্রয়াস নেয়া হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এই প্রয়াস তো নেইই উপরন্তু আদিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করার পায়তারা চলমান রয়েছে। তাদেরকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের আদিবাসী বান্ধব চরিত্র ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানাই।
নাট্যকার মামুনুর রশীদ বলেন, মধুপুরে আদিবাসী উচ্ছেদ নতুন নয়।কখনো দল, কখনো প্রভাবশালী ব্যক্তি,কখনো সরকারের বনবিভাগ এই আদিবাসীদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। যারা সাতশ বছর ধরে এই বনকে নিজেদের মা মনে করে এই বনকে রক্ষা করে আসছে তাদেরকে আজ উচ্ছেদ করা হচ্ছে।আদিবাসীরা দেশান্তরী হয়ে যাচ্ছে এবং যারা আছে তাদেরকেও বরদাশত করতে পারছি না আমরা এতই বর্ণবাদী হয়ে যাচ্ছি? বনবিভাগের দুষ্কৃতিকারীদের প্রত্যাহারেরও আহ্বান জানাই।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিন্দ্র নাথ সরকার বলেন, স্বাধীনতার দীর্ঘ পরিক্রমা পরেও আজকে মানুষের মানবাধিকার বিঘ্নিত হচ্ছে। এটা খুবই লজ্জ্বার। গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষতায় থাকার পরও আজকে এই ধরণের উচ্ছেদ চলমান রয়েছে। আদিবাসীদের ভূমির অধিকার হরণ করা হচ্ছে। বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশের সৌন্দর্য্যরে প্রতীক আদিবাসী ও সংখ্যালঘুরা দিন দিন এদেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করছি।পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর হলেও সেটির কার্যকর বাস্তবায়ন হচ্ছেনা।
সমাপনি বক্তব্যে আদিবাসী ফোরামের সাধারন সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, এই করোনার সময় শক্তি ক্ষমতা প্রদর্শনের সময় নয়। এখন মানুষের প্রতি ভালোবাসা,স্নেহ প্রদর্শনের সময়। কৃষক,শ্রমিক,খেটে খাওয়া মানুষ ও আদিবাসীদের প্রতি সংবেদনশীল হওয়ার সময়।
তিনি আরও বলেন, সংখ্যালঘু মানুষ ও আদিবাসীরা যদি ভালো থাকে তবে বুঝতে হবে বাংলাদেশ ভালো আছে। সরকারকে এই পার্থক্য বুঝতে হবে যে বড় বড় কোম্পানি,ভূমি দস্যুরা বন ধ্বংস করে এবং আদিবাসীরা বন রক্ষা করেন। অবিলম্বে সমতলের আদিবাসীদেও জন্য ভূমি কমিশন গঠনের আহ্বান জানাই। মানববন্ধন ও সমাবেশ শেষে আয়োজনটি মিছিল সহকারে টিএসসিতে গিয়ে শেষ হয়।
মানববন্ধন ও সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এডভোকেট রেজাউল করিম, বাংলাদেশ খ্রীষ্টান এসোসিয়েশন এর মহাসচিব হেমন্ত আই. কোড়াইয়া, বাগাছাসের কেন্দ্রীয় সদস্য বুশ নকরেক,নাইম হাজং,গারো স্টুডেন্টস ফেডারেশনের প্রলীন ডোপো,বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় আহবায়ক সদস্য চন্দ্রা ত্রিপুরা,গারো নকমান্দির পরিচালক থিওফিল নকরেক,কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি হিরণ মিত্র চাকমা,মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন,বাংলাদেশ খ্রীস্টান এসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ছাড়াও মানববন্ধনটি আয়োজনে ছিলেন এএলআরডি,বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ,সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন,ব্লাস্ট, বেলা,নিজেরা করি,নাগরিক উদ্যোগ,জনউদ্যোগ,কাপেং ফাউন্ডেশন,জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ,আরডিসি,বাংলাদেশ জাতীয় হাজং সংগঠন,বাংলাদেশ বানাই উন্নয়ন সংগঠন,বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরাম,মাদল, এফ মাইনর,বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ,পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ,বাগাছাস,গাসু,বাহাছাস,জিএসএফ।