দেশব্যাপী দ্বিতীয় ধাপে ৬১ পৌরসভার নির্বাচনের ভোটগ্রহণ আগামীকাল ১৬ই জানুয়ারি। গত রাতে শেষ হয়েছে প্রার্থীদের প্রচার প্রচারণা। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার মাত্রা বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি ঘটছে কাউন্সিলর প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা। এতে করে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। সুষ্ঠু ভোট আয়োজন নিয়ে শঙ্কায় নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় প্রশাসন। এযাবত পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় তিনজন নিহত হয়েছে। গত বুধবার শৈলকূপায় দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে দুইজন নিহত হয়েছে।
অন্যদিকে ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনায় একজন নিহত হয়েছে। মঙ্গলবার দিবাগত রাতে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে এ ঘটনা ঘটে। এছাড়া কুষ্টিয়ায় গত ২৬ জানুয়ারি পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া সহিংসতায় একজন নিহত হয়।
শৈলকুপা (ঝিনাইদহ) প্রতিনিধি জানান, শৈলকুপা পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর ও কাউন্সিলর প্রার্থী শওকত আলীর ছোট ভাই লিয়াকত হোসেন বল্টুকে কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষ কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকেরা। গত বুবধার সন্ধ্যার পরে কবিরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গলিতে এ হামলার ঘটনা ঘটে। নিহত লিয়াকত হোসেন বল্টু উমেদপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ঘটনার ৫ ঘণ্টা পর কাউন্সিলর প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম বাবুর মৃতদেহ নদী থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
স্টাফ রিপোর্টার, মৌলভীবাজার থেকে জানান, মৌলভীবাজার পৌরসভা নির্বাচনে ৭,৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের আনারস মার্কায় মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থী জিমি আক্তারের কর্মী সমর্থকদের উপর হামলা ও নির্বাচনী প্রচারনায় বাঁধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় জেলা রিটার্নিং অফিসার বরাবর অপর প্রার্থী শিল্পী বেগম, সুন্দর মিয়া, শিপন আহমদসহ অজ্ঞাতনামা ৫-৭জন এর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন কাউন্সিলর প্রার্থী জিমি আক্তার। লিখিত অভিযোগ তিনি জানান, ১৩ জানুয়ারী আনারস মার্কার সমর্থনে নির্বাচনী প্রচারণার সময় কাজিরগাঁও এলাকায় দিনা স্টোরের সামনে তাদের লোকজনদের নির্বাচনী প্রচারনায় বাঁধা দেওয়া হয়। এ সময় প্রতিবাদ জানালে তাদেরকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয় এবং তার বোন জেলি আক্তারকে মারপিট করা হলে তিনি আহত হন।
উল্লাপাড়া (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, উল্লাপাড়ায় আবারও কাউন্সিলর প্রার্থী ওয়াহিদুল আলম খান লিমনের টেবিল ল্যাম্প মার্কার মিছিলে মহিলা কর্মীর শ্লীলতাহানী ও কাউন্সিলর প্রার্থীকে মারপিটের অভিযোগ উঠেছে। বুধবার সন্ধ্যায় পৌর শহরের এইচটি ইমাম ডিগ্রি কলেজ মাঠে মেয়র প্রার্থী এস. এম নজরুলের নৌকা মার্কার উঠান বৈঠকে যোগ দেওয়ার সময় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী শাহ আলম ও তার সমর্থকদের মারপিটের স্বীকার হন কাউন্সিলর প্রার্থী লিমন। এতে কাউন্সিলর প্রার্থী লিমনসহ ৩ মহিলা কর্মী আহত হন। এ ঘটনায় লিমন ৮ জনের বিরুদ্ধে আবারও অভিযোগ দায়ের করেছেন থানায়।
গাংনী (মেহেরপুর) প্রতিনিধি জানান, গাংনী পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হামলায় আওয়ালীগ নেতা আব্দুল খালেক ওরফে খোকন দেওয়ান (৫৭) গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। এসময় স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে গাংনী ও পরে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। তবে তার শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। বুধবার দিবাগত রাত পৌনে ৯টার দিকে এ হামলার ঘটনা ঘটে। আহত খোকন দেওয়ান গাংনী পৌর এলাকার (৭ নং ওয়ার্ড) ভিটাপাড়ার মৃত রমজান আলীর দেওয়ানের ছেলে ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। এ দিকে খোকন দেওয়ানের লোকজন প্রতিপক্ষ ৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী মকছেদ আলীর নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর করেছে বলে পাল্টা অভিযোগ করেছেন।
স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে জানান, মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে নগরীর পাঠানটুলি ওয়ার্ডের মগপুকুর পাড় এলাকায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত ও বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীর গণসংযোগে দু‘পক্ষের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। গুলিতে আজগর আলী বাবুল (৫৫) নামে একজন নিহত হন। এঘটনায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল কাদেরকে মূল অভিযুক্ত করে এ ঘটনায় ১৩ জনের নামে হত্যা মামলা দায়ের করেছে নিহত আজগর আলী বাবুলের ছেলে সিজান মোহাম্মদ সেতু। আজগর আলী বাবুল মোগলটুলির কাটা বটগাছ এলাকার বাসিন্দা। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ আরো ২ জনকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুর বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল কাদেরকে দায়ী করেন।
সিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার ফারুক উল হক জানান, ঘটনার পর প্রতিপক্ষের বিক্ষুদ্ধ কর্মী-সমর্থকদের তোপের মুখে বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল কাদেরসহ তার অনুসারী ২৬ জনক গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে ঘটনায় সমপৃক্ত কারা আছেন তা যাচাই-বাছাই করে দেখার পর ১৩ জনকে অভিযুক্ত করে মামলা নেওয়া হয়। এতে আরো ৩০-৪০ জন অপ্সাতনামা আসামি রয়েছে।
আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুর বলেন, মোগলটুলি এলাকায় গণসংযোগ করছিলাম আমি। সেখানে মেয়র প্রার্থী রেজাউল ভাইয়ের নির্বাচনী কার্যালয়ে কিছুক্ষণ বসি। পরে নজির ভান্ডার লেইনে গণসংযোগ করতে যাই। হঠাৎ আবদুল কাদেরের উপস্থিতিতে সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর হামলার পাশাপাশি গুলিবর্ষণ করে। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে বাবুল নিহত হন। মাহবুব নামে আমার আরেকজন কর্মী আহত হয়েছেন।
নরসিংদী প্রতিনিধি জানান, নরসিংদীর মনোহরদী পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৩ কাউন্সিলর প্রার্থী, সাংবাদিক ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়েছে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আমিনুর রশিদ সুজনের সমর্থকরা। এ ঘটনায় ১২ জন আহত হয়েছেন। বুধবার গভীর রাতে মনোহরদী হিন্দুপাড়াসহ পৌরসভার বিভিন্ন স্থানে এসব ঘটনা ঘটেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানায়, বুধবার রাত ৮টায় মনোহরদী হিন্দুপাড়া সার্বজনীন দুর্গাবাড়িতে মেয়র আমিনুর রশিদ সুজনের সর্বশেষ উঠান বৈঠক হয়। সভায় কাউন্সিল প্রার্থীরা তাদের সমর্থকদের নিয়ে যোগ দেয়। রাত ১১টার দিকে সভা শেষে ফেরার পথে কাউন্সিলর প্রার্থী হারুন মাঝি ও খোকন রায়ের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে হারুন মাঝির পক্ষে অবস্থান নেয় মেয়র সুজনের সমর্থকরা। আর খোকন রায়ের পক্ষে অবস্থান নেয় সাদীর সমর্থকরা। উভয় পক্ষের সংঘর্ষে মেয়রের দুই ভাইসহ কমপক্ষে ১২ জন আহত হয়। এ সময় উভয় পক্ষের ৫টি মোটরসাইকেল ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এডভোকেট ফজলুল হকের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মেয়র সুজনের নেতৃত্বে শত শত সমর্থক মনোহরদী বাসস্ট্যান্ডে জড়ো হয়। সেখান থেকে মেয়রের সমর্থকরা প্রথমে মনোহরদী হিন্দুপাড়ার মনোহরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং নরসিংদী জেলা টেলিভিশন জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক সাংবাদিক সুমন বর্মণ, কাউন্সিলর প্রার্থী পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক খোকন রায়, সুকোমল সাহার বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। পরে একে একে চকপাড়া এলাকায় ৫ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী উপজেলা যুবলীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক শরীফ রায়হান ও তার সমর্থকদের বাড়িঘর ও অফিসে, ২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোতাহার হোসেনের অফিস ও উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শফিকুল ইসলামের মডার্ন ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করে। এই ঘটনায় মেয়র সুজন মন্ত্রীর ছেলে সাদীকে দায়ী করে তার সহযোগীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে ৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী খোকন রায় বলেন, মেয়র সুজন ও কাউন্সিলর প্রার্থী হারুন মাঝি আমার বাড়ি ও সমর্থকদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছে। তারা পরিকল্পিতভাবে এই বিশৃঙ্খলা ঘটিয়েছে যাতে ভোটের পরিবেশ নষ্ট হয়।
মনোহরদী পৌরসভার আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আমিনুর রশিদ সুজন বলেন, হিন্দুপাড়ায় আমি আমার নির্বাচনী উঠান বৈঠক শেষ করে চলে যাওয়ার সময় আমার ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। ধারালো অস্ত্র দিয়ে আমাকে আঘাত করার সময় আমার দুই ভাই আমাকে বাঁচাতে গেলে তারা গুরুতর আহত হয়েছে। এ ঘটনায় আমার ১২ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছে।
মনোহরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান বলেন, দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই ঘটনা ঘটেছে। বর্তমানে পরিস্থিতিতে পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আইনশৃঙ্খলার যাতে অবনতি না হয় সেজন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।