২০০৮ সালের পহেলা জানুয়ারি জামালপুরের রনি ও নরসিংদীর ইয়াসমিন আক্তারের বিয়ে হয়েছিল। পেশায় রিকশাচালক রনি স্ত্রী, দুই সন্তান ও শ্যালিকাকে নিয়ে থাকতেন ঢাকার পূর্ব নাখালপাড়ার একটি বাসায়। রনি রিকশা চালিয়ে যা আয় করতেন তার সবই জুয়া খেলে শেষ করতেন। এ কারণে সংসারে প্রায়ই অভাব-অনটন লেগে থাকতো। অভারের তাড়নায় খেয়ে না খেয়ে তাদের সংসার চলতো। ঠিকমতো খাবার না জুটায় রনির স্ত্রী ইয়াসমিন দুই সন্তানকে তার মায়ের কাছে রেখে আসেন। কিন্তু তাতেও সচ্ছলতা আসেনি তাদের পরিবারে। ভ্যান ও রিকশা চালিয়ে আয়ের সবটুকুই জুয়া খেলে শেষ করতেন রনি।
এ নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে প্রায়ই বাকবিতণ্ডা ও ঝগড়া হতো। রনি মাফ চেয়ে বলতেন আর তিনি জুয়া খেলবেন না। কিন্তু শুধরাননি রনি। পরে অভাবের সংসারের ইতি টানতে রনিকে ডিভোর্স দেন তার স্ত্রী ইয়াসমিন। রনি সেটা মেনে নিতে পারেননি। আলাদা থাকলেও তিনি ফের ইয়াসমিনের সঙ্গে সংসার করতে চেয়েছিলেন। এজন্য ইয়াসমিনকে তিনি অনেকবার বুঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ইয়াসমিন তাতে রাজি হননি। সর্বশেষ গতকাল দুপুরে সেই চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে প্রথমে শ্যালিকা ও পরে স্ত্রীকে হত্যা করেন। এ ঘটনায় পুলিশ রনিকে গ্রেপ্তার করেছে। হত্যাকাণ্ডের দায়ও স্বীকার করেছেন রনি।
গতকাল দুপুরের দিকে পূর্ব নাখালপাড়ার একটি বাসা থেকে ইয়াসমিন আক্তার (২৮) ও শিমু আক্তার (১৭) নামের দুই নারীর মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তারা দু’জনে সম্পর্কে সৎ বোন। ইয়াসমিন আক্তার রনির সাবেক স্ত্রী ও শিমু আক্তার তার শ্যালিকা। ইয়াসমিন একটি তৈরি পোশাক কারখানায় আর শিমু সমপ্রতি নাবিস্কো এলাকায় একটি প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করতেন। দু’জনের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে নেয়া হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্সের পর ঢাকার পূর্ব নাখালপাড়ার ২৫৩/৩ ভবনের তৃতীয় তলায় একটি কক্ষে ইয়াসমিন তার সৎ বোন শিমু আক্তারকে নিয়ে থাকতেন।
পুলিশ জানিয়েছে, দুপুর ১টার দিকে ২৫৩/৩ পূর্ব নাখালপাড়া ভবনের তৃতীয় তলায় একটি কক্ষে রনি তার স্ত্রীকে দা দিয়ে কোপাচ্ছিলেন, যা আশপাশের লোকজন জানালা দিয়ে দেখতে পান। তখন তারা ভবন মালিককে ফোন করে বিষয়টি জানান। আশপাশের লোকজন সেখানে জড়ো হন। লোকজনের উপস্থিতি টের পেয়ে রনি ভেতর দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। পরে দরজা ভেঙে কক্ষে প্রবেশ করেন আশপাশের লোকজন। ঘরে ঢুকে তারা ইয়াসমিনের নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখেন। পাশেই খাটের মধ্যে পড়েছিল তার শ্যালিকার মরদেহ।
তেজগাঁও পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রনি ভ্যান ও রিকশা চালিয়ে যে টাকা আয় করতেন সেটি দিয়ে জুয়া খেলতেন। এ কারণে তার পরিবারে অভাব-অনটন লেগে থাকতো। তার স্ত্রী ইয়াসমিন বারবার সতর্ক করে দেওয়ার পরও তিনি জুয়া খেলতেন। মাঝে-মধ্যে মাফ চাইতেন কিন্তু পরে আবার একই কাজ করতেন। এসব কারণে বিরক্ত হয়ে চার মাস আগে তার স্ত্রী তাকে ডিভোর্স দেন। পরে রনি মগবাজার ওয়্যারলেস এলাকায় চলে যান। ডিভোর্সের পরে রনি বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছেন সংসার টিকিয়ে রাখার। কিন্তু তার স্ত্রী ইয়াসমিন তাতে রাজি হননি।
সংসার শুরু করার জন্য গতকাল দুপুরেও স্ত্রীকে বোঝাতে নাখালপাড়ার ওই বাসার তিনতলার একটি কক্ষে যান রনি। সেখানে গিয়ে তার শ্যালিকাকে পান। সংসারটা আবার শুরু করার জন্য রনি তার শ্যালিকাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। শ্যালিকা যেন তার বোনকে বোঝায়। তখন শ্যালিকা তার বিগত দিনের কর্মকাণ্ড সামনে নিয়ে এসে কথা বলে। এ সময় শ্যালিকাকে কোনোভাবেই তিনি বোঝাতে পারছিলেন না। শ্যালিকা তার জুয়া খেলা, অভাব-অনটনসহ নানান বিষয়ে কথা বলতে থাকে। একপর্যায়ে রনি তার শ্যালিকার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে তার গলা টিপে ধরে হত্যা করে। তার মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর খাটের ওপর রেখে কাঁথা দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করেন। এ সময় রনির সাবেক স্ত্রী ইয়াসমিন ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে দেখেন তার বোন মৃত। হত্যাকাণ্ডের কথা ইয়াসমিন জেনে যাওয়াতে রনি তাকেও রুমের মধ্যে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন।
পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে রনি জানিয়েছেন, ২০০৮ সালের পহেলা ডিসেম্বর ইয়াসমিনের সঙ্গে রনির বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই সৎ শ্যালিকা শিমু তাদের সঙ্গে থাকতো। শিমু ছোটবেলা থেকেই তাদের সংসারে রয়েছে। রনির দাবি ছিল শিমু যেহেতু প্রথম থেকেই সংসারে ছিল তার সবকিছু জানা। তাই শিমু যেন তার বোনকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ফের সংসার করতে রাজি করায়। সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য শিমু যেন ভূমিকা রাখে। কিন্তু শিমু তাতে রাজি হয়নি। এজন্য ক্ষিপ্ত হয়েই তাকে গলাটিপে হত্যা করেছে।
ডিএমপি’র তেজগাঁও বিভাগের উপ- পুলিশ কমিশনার হারুন-অর-রশীদ মানবজমিনকে বলেন, পারিবারিক কলহ থেকে এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে। আমরা ঘাতক রনিকে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে গ্রেপ্তার করেছি। প্রাথমিকভাবে সে আমাদের কাছে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। আমরা তাকে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করছি।