চট্টগ্রাম: মাছের আঁশ। যা কাপড়-চোপড়ে লাগলে লাফিয়ে ওঠে যে কেউ। হাতে লাগলে ধোয়ার জন্য পাগল হয়ে যায়। যেন অপবিত্র দুর্গন্ধময় এক বর্জ্য। সেই বর্জ্য এখন রপ্তানির মাধ্যমে শতকোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
শুধু স্বপ্ন নয়, গত দু’বছর ধরে মাছের আঁশ রপ্তানি থেকে আয় শুরু করেছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার বহু মানুষ। বেছে নিয়েছে জীবকার পথ। এমনি একজন চট্টগ্রাম মহানগরীর চর বাকলিয়া এলাকার বাসিন্দা ওসমান গণি। গত শনিবার দুপুরে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে মাছের আঁশ শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন তিনি।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, নগরীর বিভিন্ন বাজার থেকে মাছের আঁশ সংগ্রহ করে ধুয়ে রোদে শুকাই। পরে পার্টির কাছে বিক্রি করি। তবে প্রতি কেজি শুকানো আঁশ আগে ১২০-১৩০ টাকায় বিক্রি হতো। করোনার কারণে তা কমে ৩৫-৪০ টাকায় নেমে এসেছে। ফলে আগে মাসিক ৬০-৭০ হাজার টাকা আয় হতো। এখন ২০-৩০ হাজার টাকা আয় হয়। করোনা চলে গেলে হয়তো দাম আবারো বাড়বে।
তিনি বলেন, দুর্গন্ধময় বর্জ্য মাছের আঁশ যে সম্পদ হতে পারে তা কখনো চিন্তা করিনি। নগরীর ফিশারিঘাট এলাকার মানিক আমাকে এ পথ দেখিয়েছেন। মানিক মুঠোফোনে বলেন, আমিও ভাবিনি মাছের আঁশও সম্পদ হতে পারে। খুলনার মা এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কোম্পানি নামে একটি প্রতিষ্ঠান দু’বছর আগে আমার কাছে মাছের আঁশ কেনার প্রস্তাব দেয়।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইমরুল মুঠোফোনে বলেন, বিদেশে মাছের আঁশের বড় বাজার রয়েছে। এ জন্য আমরা সারা দেশ থেকে মাছের আঁশ সংগ্রহ করি। চট্টগ্রাম মাছের আঁশ সংগ্রহের বড় বাজার। তাই বাজার থেকে মাছের আঁশ সংগ্রহ করার উদ্যোক্তা তৈরি করছি আমরা। এই আঁশ ভবিষ্যতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম একটি খাত হতে পারে। তবে এ জন্য সরকারের উদ্যোগ প্রয়োজন।
ওসমান গণি ও মানিকের মতে, চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন বাজারে যারা মাছ কাটেন তাদের কাছ থেকে আঁশ সংগ্রহ করা হয়। সেখান থেকে কান, লেজের অংশ, নাড়ি-ভুঁড়িসহ কিছু বর্জ্য ফেলে দেয়া হয়। এরপর হালকা গরম পানিতে ধুয়ে দু’দিন রোদে শুকালে মচমচে হয়ে যায়। রোদে শুকানো আঁশ ২৫ কেজি করে প্যাকেট করা হয়। পরবর্তীতে আঁশগুলো কারখানার মালিকরা গুঁড়া করে। তাদের কাছ থেকে রপ্তানিকারকরা সংগ্রহ করেন।
তাদের মতে, মাছের আঁশের গুঁড়া দিয়ে মুরগি ও মাছের খাবার তৈরি হয়। ওষুধ কোম্পানিগুলোতে ক্যাপসুলের কভার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। লিপস্টিক, নেইলপালিশসহ বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনেও ব্যবহৃত হচ্ছে। রিচার্জেবল ব্যাটারি তৈরির কাঁচামাল, বিভিন্ন ধরনের খেলনা, বোতাম, চিরুণি ও কুটির শিল্পসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে এই আঁশ।
তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, চট্টগ্রাম জেলা ইনচার্জ আলতাফ হোসাইন ভূঁইয়া বলেন, মাছের আঁশ থেকে নানা ধরনের পণ্য তৈরি হচ্ছে। ফলে দেশীয় বাজারের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে মাছের আঁশ। বিশেষ করে জাপান, চীন, হংকং ও ভিয়েতনামসহ বিশ্বের নানা দেশে মাছের আঁশ যাচ্ছে। চট্টগ্রামে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনেকেই এই ব্যবসায় জড়িত। তবে ঢাকা ও খুলনা অঞ্চলে তিনটি কারখানা থেকে নিয়মিত মাছের আঁশ রপ্তানি হচ্ছে। তিনি বলেন, মাছের আঁশ রপ্তানির সঙ্গে জড়িতরা বাজার সম্প্রসারণে নানাভাবে চেষ্টা করলেও করোনার কারণে সংকটে পড়েছেন। আঁশ রপ্তানির পরিমাণ আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। এক বছর আগে যে প্রতিষ্ঠান দেড় লাখ ডলারের আঁশ রপ্তানি করেছে, ওই প্রতিষ্ঠান গত ১১ মাসে ২০ হাজার ডলারের আঁশও রপ্তানি করতে পারেনি। তিনি বলেন, মাছের আঁশের বর্জ্য ব্যবহার করে যারা সোনা ফলাচ্ছে, তারা দেশের জন্য বড় কিছু করছে। যে বর্জ্য থেকে এক টাকাও পাওয়া যেত না, এমনকি বর্জ্য অপসারণে রাষ্ট্রীয় অর্থ খরচ হতো, সেই খাত থেকে এখন কোটি টাকা আয় আসছে। মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। এদের পৃষ্ঠপোষকতা করলে রাষ্ট্র ও সমাজ উপকৃত হবে।
সূত্রমতে, রপ্তানি ছাড়াও মাছের আঁশের বড় বাজার গড়ে উঠেছে দেশে। ঘরে ঘরে মাছের যে আঁশ পাওয়া যায় তা এখনো বাজারের বাইরে রয়ে গেছে। হোটেল রেস্তোরাঁ, কমিউনিটি সেন্টারকে এই প্রক্রিয়ার আওতায় আনা গেলে বর্জ্য হিসেবে স্বীকৃত মাছের আঁশ রপ্তানি করে বছরে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে।