ভালো নেই দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি। চলমান করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যেই জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় অসহায় হয়ে পড়েছেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষগুলো। এ সময় আয় কমে গেছে। কারো রোজগারও বন্ধ হয়ে গেছে। করোনা মোকাবিলায় প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু এই প্রণোদনা থেকেও অনেকটা বঞ্চিত তারা। মধ্যবিত্ত হিসেবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের ব্যবসায়ীরা কিছুটা প্রণোদনা পেলেও হিসাবের বাইরে থেকেছেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির যারা কিছুই করেন না। ফলে চরম সংকটে পড়েছে মধ্যবিত্তদের জীবন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণায়ও এমন পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিটি নিত্যপণ্যসহ ওষুধ, পরিবহন ব্যয়, বাড়িভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল বেড়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেও লাভ হচ্ছে না। বেড়েছে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়। অথচ আয় বাড়েনি। এ অবস্থায় মধ্যবিত্তদের আয়ের সঙ্গে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে প্রতিদিনের বাজার তালিকা কাটছাঁট করতে হচ্ছে। পেশা পরিবর্তন করেও টিকতে পারছেন না অনেকে। কেউ কেউ নিরুপায় হয়ে জমানো পুঁজি ভাঙিয়ে খরচ করছেন। অনেকে রাজধানী ছেড়ে চলে গেছেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, মানুষের এখন আয়- রোজগার নেই। যারা আয় করছেন তাদের রোজগারও কমে গেছে। অনেকেই জমানো টাকা ভেঙে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে ‘পণ্যমূল্য বৃদ্ধি’ মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। অসহায় হয়ে পড়েছেন পেশাজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ।
ব্র্যাক, ডেটা সেন্স এবং উন্নয়ন সমন্বয়-এর এক যৌথ সমীক্ষায় করোনায় বাংলাদেশের ১০ কোটি ২২ লাখ মানুষের আয় কমে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে করুণ অবস্থায় রয়েছে মধ্যবিত্ত।
পিউ’র গবেষণায় বলা হয়, ২০০১ সালের তুলনায় ২০১১ সালে দেশের মোট আয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অংশ কমে গেছে। ২০০১ সালে মোট আয়ে মধ্যবিত্তদের অংশ ছিল ১৭.৫ শতাংশ। আর ২০১১ সালে সেটি হয়েছে মাত্র ১.৪ শতাংশ। অর্থাৎ ১০ বছরে আয়ে মধ্যবিত্তের অংশ কমেছে ১৬.১ শতাংশ পয়েন্ট।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০১ সালে বাংলাদেশে মোট গরিব মানুষ ছিল ৫৫.২ শতাংশ, ২০১১ সালে তা কমে হয়েছে ৩৯.১ শতাংশ। নিম্ন আয়ের মানুষ ছিল মোট জনসংখ্যার ৪৩.৭ শতাংশ, ১০ বছরে তা হয়েছে ৫৯.৩ শতাংশ। আর ২০০১ সালে মধ্যম আয়ের মানুষ ছিল ১ শতাংশ, সেটি সামান্য বেড়ে হয়েছে ১.৪ শতাংশ। উন্নয়নশীল বিশ্বের একটি বড় অংশ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উন্নীত হলেও বৈশ্বিক আর্থিক মন্দার কারণে তারা এখন চাপে আছে। পিউ রিসার্চ বলছে, মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই আগের চেয়ে দরিদ্র হয়েছে। দৈনিক ১০ থেকে ২০ ডলার বা ৮০০ থেকে ১,৬০০ টাকা আয় করা ৪ সদস্যের পরিবারকে মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে পিউ রিসার্চের গবেষণায়। এ হিসেবে বিশ্বে মধ্যবিত্ত শ্রেণির জনসংখ্যা এখন ১৭০ কোটি।
মধ্যবিত্ত শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে অসহায় হয়ে পড়েছেন তারা। তাদের মতে, মাসের থাকা-খাওয়ার ব্যয় এতই বেড়েছে যে, ঢাকা শহরে টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে তারা জানান, বাজার ব্যবস্থার উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রতিনিয়ত একটার পর একটা পণ্যের মূল্য বাড়ছে। এসব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়ে গেছেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ।
সিরাজগঞ্জ থেকে আসা মাইনুল ব্যবসা করতেন রাজধানীর মধুবাগ বাজারে। তিনি বলেন, ডেকোরেটরের ব্যবসা করতাম। ৫ মাস ধার করে দোকান ভাড়া দিয়েছি। কাজ নেই আর কুলিয়ে উঠতে পারছি না। তাই উপায় না পেয়ে দীর্ঘদিনের পেশা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। জীবনের তাগিদে অন্য কোনো কাজ না পেয়ে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছি।
সম্প্রতি এক ওয়েবিনারে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, করোনায় ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির থাকায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ওপর প্রভাব পড়েছে। তবে মধ্যবিত্ত এবং খেটে খাওয়া মানুষগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দেশি পিয়াজের দাম ৭০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে। আলু এখনও ৪০-৫০ টাকা। ভালো মানের মিনিকেট চাল ৬০-৬২, মাঝারি মানের মিনিকেট ৫৫-৬০ টাকা। বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১০০-১০৫ টাকা লিটারে। গুঁড়োদুধের দাম বেড়েছে কেজিতে ২৫-৩০ টাকা। ৬০ টাকার নিচে সবজি পাওয়া মুশকিল। কাঁচামরিচ এক পোয়া (২৫০ গ্রাম) ২০-৩০ টাকা। কেজিতে মসুর ডালের দাম বেড়েছে ৫-১০ টাকা।
এদিকে সম্প্রতি বেসরকারি সংগঠন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এক গবেষণার তথ্য মতে, করোনাকালে রাজধানী ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে অন্তত ১৬ শতাংশ দরিদ্র মানুষ। তাদের মতে, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা খরচ, যোগাযোগের ব্যয় এবং অন্য নানামুখী ব্যয় মেটাতে না পেরেই এসব মানুষ ঢাকা ছেড়েছে। তবে করোনার প্রভাব বেড়ে গেলে ঢাকা ছাড়ার সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যাবে।
বিআইজিডি ও পিপিআরসি’র, যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক কাজ হারিয়েছে সবচেয়ে বেশি এবং যে কোনো পেশায় নারীদের ওপর পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি নেতিবাকক প্রভাব পড়েছে। ১৭% পরিবারের কোনো আয়মূলক কাজ নেই। জরিপে অংশ নেয়া নারী উদ্যোক্তারা জানান, ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তারা সরকার ঘোষিত কোনো প্রণোদনা সুবিধা পাচ্ছেন না।
বিআইজিডি’র সিনিয়র ফেলো মাহীন সুলতানা জানান, করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট ব্যবসায়িক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তার ৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তারা পাবেন। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে সঠিক নির্দেশনা দিতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
রাজধানীর একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বলেন, বেসরকারি খাতের চাকরির আয় ঝুঁকির মুখে পড়েছে। একটি অংশের চাকরি আছে, কিন্তু বেতন নেই। আবার কারও বেতন কমে গেছে। অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে নিম্নবিত্তের কাতারে নেমে গেছেন। বাচ্চাদের ক্লাস বন্ধ, মাত্র শুরু হয়েছে কিছু কিছু অনলাইন। কিন্তু টিউশন ফি দিতে হচ্ছে পুরোটাই। মধ্যবিত্তের এই অবস্থাটাই অর্থনীতিতে একটা স্থবিরতা নিয়ে আসতে পারে। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে মধ্যবিত্তের মনে সৃষ্ট এই অনিশ্চয়তার শঙ্কা কীভাবে দূর করা যায় সেই ভাবনাটা প্রয়োজন।
পিপিআরসি’র নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, করোনার মহামারি দেশে দারিদ্র্যের বিস্তার ও প্রকৃতি দু’টোকেই বদলে দিচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশে এক দশকে সংখ্যা ও গুণগত দিক থেকে একটি নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিকশিত হয়েছে। করোনার ফলে বিকাশমান মধ্যবিত্তের নিম্নবিত্ত অংশটি ভীষণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। তবে বাংলাদেশের আগামী দিনের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিকাশমান মধ্যবিত্তের বড় ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।