ঢাকা: বর্তমানে কম্পিউটার আমাদের জীবন ও আমাদের প্রচলিত অনেক ধারনাকে আমূল বদলে দিয়েছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক সাধন করেছে ইন্টারনেট। ইন্টারনেটের আরেকটি সফলতা হলো ই-কমার্স।
আধুনিক বিশ্বে বহু আগে থেকেই ই-কমার্সের প্রচলন ঘটলেও আমাদের দেশে সীমিত পরিসরে মাত্র কিছুদিন হলো কিছু ব্যবসায় ই-কমার্সের প্রচলন ঘটেছে। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হয়ে ওঠার যথেষ্ঠ সুযোগ রয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় ই-কমার্স একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে আমাদের সবার ই-কমার্স জানা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে সিক্ষাতকার দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিস ডিপার্টমেন্টের সহযোগি অধ্যাপক ড. মুশফিক মান্নান চৌধুরী। তিনি সাউথ্যাম্পটনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। আগামী দিনের বাংলাদেশের ই-কমার্সকে কিভাবে সমৃদ্ধ করা যায় এ বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দেন তিনি।
ই-কমার্স কি?
ড. মুশফিক মান্নান: ইলেকট্রনিক কমার্স কে সংক্ষেপে ই-কমার্স বলা হয়। এটি একটি আধুনিক ব্যবসা পদ্ধতি। ইন্টারনেটের মাধ্যমে এ ব্যবসা এবং লেনদেন পরিচালিত হয়ে থাকে। বস্তুত ইলেকট্রনিক কমার্স হচ্ছে ডিজিটাল ডাটা প্রসেসিং এবং ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা সংক্রান্ত আদান প্রদান। সাধারণত এ কাজটি সম্পাদন করা হয় সবার জন্য উন্মুক্ত একটি নেটওয়ার্ক তথা ইন্টারনেটের মাধ্যমে। তাই বলা যায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা সংক্রান্ত আদান প্রদান বা লেনদেন করার প্রক্রিয়াই হলো ই-কমার্স।
ই-কমার্সের প্রর্বতন কবে থেকে ?
ড. মুশফিক: সত্তর দশকে ই-কমার্সের সুচনা হয়। কিন্তু আমরা বর্তমানে যে ই-কমার্স সিস্টেমটি দেখছি এ পর্যায়ে প্রায় ৩০ বছর সময় লেগেছে। গত ৩০ বছরে ইলেকট্রনিক কমার্সের মানেটাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে ইলেকট্রনিক কমার্স বলতে প্রথমে যা বোঝা যেত সেটি হলো ইলেকট্রনিক ডেটা ইন্টারচেঞ্জ(ইডিআই) এবং ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার(ইএফটি) এর মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাণিজ্যিকভাবে আর্থিক লেনদেন। এই উভয় প্রযুক্তিই ১৯৭০ সালের পরে চালু হয়। এর ফলে ব্যবসার ক্ষেত্রে পারচেজ অর্ডার কিংবা ইনভয়েসের মতো বাণিজ্যিক ডকুমেন্টগুলো ইলেকট্রনিক উপায়ে প্রেরন করার সুযোগ তৈরি হয়। ই-কমার্সের আরেকটি রূপ ছিল এয়ারলাইন রিজার্ভেশন সিস্টেম প্রবর্তন। যুক্তরাষ্ট্রে স্যাবরে এবং যুক্তরাজ্যে ট্রাভিকম নামের দুটি প্রতিষ্ঠান এর প্রচলন ঘটায়। মিশেল আলড্রিচ এর হাত ধরে ১৯৭৯ সালে যুক্তরাজ্যে অনলাইন শপিং এর পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। ১৯৯০ সাল থেকে ই-কমার্সে যুক্ত হয় এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স সিস্টেম, ডেটা মাইনিং এর মত বিষয়গুলো। ১৯৯৪ সালের দিকে ইন্টারনেট ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তারপরও সিকিউরিটি প্রটোকলসমূহ ও ডিএসএল (DSL) এর প্রচলন হতে আরও পাঁচ বছর সময় লাগে। এর ফলে ইন্টারনেট সংযোগের ক্ষেত্রে ঘটেছে অভাবনীয় উন্নতি। ২০০০ সালের দিকে অসংখ্য ইউরোপ এবং আমেরিকান ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের সেবাগুলো ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের মাধ্যমে শুরু করে। এরপর থেকে সবাই ই-কমার্স নামের সঙ্গে ক্রমেই পরিচিত হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশে ই-কমার্স নিয়ে কি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে ?
ড. মুশফিক: বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে ই-কমার্স একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে। কিন্তু ই-কমার্সের জন্য বাংলাদেশের অনেক সমস্যা রয়েছে। প্রথম সমস্যা হলো পেমেন্ট। ক্রেতা তার ক্রেডিট কার্ড, ডেভিট কার্ড বা পেপালের মাধ্যমে পণ্য ক্রয় করতে পারছেন না। তাই বিক্রেতাও সহজে তার পণ্যের মূল্য পাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পেপালের অনুমতি।
অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন একটি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন যেখানে দেশের বাইরে সম্ভব না হলে ভেতরেই ই-কমার্সকে ব্যবহার করার চেষ্টা করা।
এ ছাড়া আমাদের দেশে ই-কমার্সের বড় প্রতিবন্ধকতা হল পণ্য পৌঁছে দেওয়ার সময় ঠিকানা সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। যে কারণে পণ্যটি ক্রেতার হাতে পৌঁছতে কয়েক দিন সময় ব্যয় হয়। তাই ক্রেতা ই-কমার্স এর ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
ই-কমার্স নিয়ে আমাদের সম্ভাবনা কতটুকু?
ড. মুশফিক: আমাদের দেশের ই- কমার্সের ক্ষেত্রে বিক্রয় ডটকম বা ওএলএক্স ডটকম সাড়া জাগালেও তারা মূলত মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। তাদের নিজস্ব পণ্য নয় বরং অন্যের পণ্য বিক্রি করার সুযোগ করে দিচ্ছে। ইউরোপের দেশগুলোর মত বাংলাদেশে ই-কমার্স চালু হলে আমরা আমাদের পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্রি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারতাম। সরকারও পণ্য থেকে অনেক পরিমাণে ভ্যাট পেতো।
সোশ্যাল মিডিয়া গুলো আমাদের দেশে কি রকম ভুমিকা রাখছে ?
ড. মুশফিক: সোশ্যাল মিডিয়াগুলো শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বের প্রায় সকল দেশকে প্রভাবিত করেছে। বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী বা রাজনীতিবিদ সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ করতে পারছে। বিভিন্ন মানুষ তাদের সমস্যার কথা মন্ত্রীকে সরাসরি জানাতে পারে।
এ ছাড়া যে কোন কোম্পানি তার কোম্পানির নামে সোশ্যাল মিডিয়াতে ফ্যান পেইজ খুলে তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন দিতে পারছে, সেই সঙ্গে তাদের পণ্য মানুষ কিভাবে গ্রহণ করেছে, পণ্যের মান উন্নয়ন সম্পর্কে সেখানে বিভিন্ন জন একাধিক মতামত দিতে পারছে। এর মাধ্যমে গ্রাহকদের সঙ্গে সেই কোম্পানির একটি সরাসরি যোগাযোগ হচ্ছে।
আপনি তো সরাসরি শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থার মান সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
ড. মুশফিক: আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা একসময় সারা বিশ্বে সুনাম অর্জন করেছিল। বর্তমানে সেই সুনাম থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।
কি উপায়ে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার মান উন্নয়ন করা যেতে পারে ?
ড. মুশফিক: দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক সমস্যা রয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের মুখস্থ বিদ্যার দিকে বেশি আগ্রহী করে তুলছে শিক্ষকরা। আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষকরা ক্লাসে বেশি মনযোগ দিতে পারছেন না। তারা প্রাইভেটের দিকে ছাত্র-ছাত্রীদের ঝুঁকতে বাধ্য করছে। এই সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন শিক্ষকদের সামঞ্জস্যপূর্ণ বেতন। বর্তমানে শিক্ষকদের বেতন কম হওয়ার কারণে তারা প্রাইভেটকে বেছে নিচ্ছে।
ডিজিটাল ক্লাসরুমে গড়তে কি প্রয়োজন?
ড. মুশফিক: ডিজিটাল ক্লাস রুমের জন্য প্রয়োজন অনেক কিছু। যার মধ্যে রয়েছে প্রজেক্টর ব্যাবহার, ছাত্র- ছাত্রীদের কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের উপর দক্ষতা বাড়ানো। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
তথ্যপ্রযুক্তির দিক দিয়ে বাংলাদেশ কতটুকু এগিয়ে ?
ড. মুশফিক: তথ্য প্রযুক্তির দিক দিয়ে বাংলাদেশ এখনো তেমন বেশি অগ্রগতি নেই। আমাদের দেশে মাত্র কয়েকদিন আগে থ্রিজি চালু হয়েছে, কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে অনেক আগে থ্রিজি চালু হয়েছে। এদিকে দিয়ে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যেসব সেবা বা পণ্য বিলুপ্তির পথে থাকে সেসব পণ্য বা সেবাগুলো বাংলাদেশে নতুনভাবে আসছে। এ থেকেই বুঝা যায় আমরা প্রযুক্তির দিক দিয়ে কতটুকু পিছিয়ে রয়েছি।