হাটহাজারী (চট্টগ্রাম): হেফাজতে ইসলামের নয়া আমীর আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বলেছেন, মদিনা সনদে দেশ চললে এদেশে কোনো ভাস্কর্য থাকতে পারে না। মদিনায় কোনো ভাস্কর্য নেই। এদেশেও কোনো ভাস্কর্য থাকতে পারে না। আমি কোনো নেতার বা দলের নাম বলবো না। আমি শরীয়তের কথা বলবো। শরীয়তে কোনো ভাস্কর্যের অনুমতি নেই। আমাদের নবীর কোনো ভাস্কর্য কোথাও নেই। নবীর চাইতে তো বেশি আমরা কাউকে ভালোবাসি না।
তাহলে অন্য কারও ভাস্কর্য থাকবে কেন? যেকোনো দলের নেতা বা ব্যক্তির ভাস্কর্য বসাক না কেন, এমনকি আমার বাবার ভাস্কর্য বসালেও সেটা টেনেহিঁচড়ে ফেলে দেবো। চট্টগ্রামের হাটহাজারী পার্বতী মডেল উচ্চ বিদ্যালয় ময়দানে শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ (রহ.), আল্লামা শাহ মুহাম্মাদ তৈয়ব (রহ.) ও আল্লামা ইদ্রীস (রহ.)-এর জীবন, কর্ম ও অবদান শীর্ষক আলোচনা ও ঐতিহাসিক তাফসীরুল কুরআন মাহফিলের সমাপনী দিনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
এদিকে চট্টগ্রামে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হককে প্রতিহতের ডাক দেয় ছাত্রলীগ-যুবলীগ। তাকে প্রতিহত করতে দিনভর চট্টগ্রামের বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা। এ নিয়ে চট্টগ্রামে দিনভর উত্তেজনা বিরাজ করে। তবে ঢাকা থেকে বৃহস্পতিবার রাতে হাটহাজারী মাদ্রাসায় হাজির হলেও গতকাল সমাবেশস্থলে যাননি মাওলানা মামুনুল হক। এদিকে হেফাজত আমীর বাবুনগরী বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, মদিনার সনদে দেশ চলবে। প্রধানমন্ত্রীর এ কথার সঙ্গে সহমত পোষণ করছি। আমরাও চাই মদিনার সনদে দেশ চলুক। এই দেশ আমেরিকার সনদে চলতে পারে না, রাশিয়ার সনদে পারে না, ভারতের সনদে চলতে পারে না, ফ্রান্সের সনদে চলতে পারে না। ৯০% মুসলিম অধ্যুষিত এই বাংলাদেশ মদিনার সনদেই চলবে। মদিনার সনদে দেশ চললে দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে, সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে, সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে উঠবে। এ সনদের আলোকেই পৃথিবীতে আদর্শ ইসলামী সমাজ ও আন্তর্জাতিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।
সরকারের উদ্দেশ্যে হেফাজত আমীর বলেন, আমরা আপনার দুষমন নই, আপনার আশেপাশে ঘাপটি মেরে থাকা রাম-বাম আর নাস্তিক মুরতাদরাই আপনার প্রকৃত দুষমন। তারা আপনাকে ইসলামের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে তৌহিদী জনতা ও আপনার মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে চায়। ওদেরকে চিহ্নিত করুন। হেফাজতে ইসলামের কোনো ভূমিকা সরকারের বিরুদ্ধে নয়। আমরা সরকার বা দেশবিরোধী নই। ইসলাম, মুসলমান, দেশ ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী আমরা। আমরা বাতিল ও নাস্তিক মুরতাদ বিরোধী, কোনো দল বা পার্টির বিরুদ্ধে নই। ইসলাম বিরোধী অপশক্তি এবং রাসুলের দুষমন নাস্তিক মুরতাদদের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলামের ভূমিকা ছিল, আছে এবং থাকবেই। আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী আরো বলেন, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ কোনো পার্টি বা দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে না। হেফাজতে ইসলাম আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুল (সা.) এর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে। হেফাজতে ইসলাম সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, ঈমান-আকিদা ভিত্তিক একটি সংগঠন। মসজিদের ইমাম মুসল্লিরা, মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ, ভার্সিটির ধর্মপ্রাণ ছাত্র-শিক্ষক ও দেশের সকল পরহেজগার মুসলমান হেফাজতের কর্মী ও সদস্য।
মামুনুল হকের কুশপুত্তলিকা দাহ করা, শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হককে রাজাকার ডাকার প্রতিবাদ জানিয়ে বাবুনগরী বলেন, দেশের একজন শীর্ষ স্থানীয় আলেম মাওলানা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে এসব অবমাননা সহ্য করা হবে না। অনতিবিলম্বে এসব ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। একজন নায়বে নবী আলেমকে নিয়ে এমন ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ড কখনো মেনে নেয়া যায় না। এই আল আমিন সংস্থার মাহফিলে আল্লামা মামুনুল হকের বয়ান করার কথা ছিল। কিন্তু হাটহাজারীতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের বাধা ও সড়ক অবরোধের কারণে তাকে নিষেধ করা হয়েছে মাহফিলে না আসতে। তিনিও বলেছেন, আমি মাহফিলে যাব না, আমাকে ছাড়াও মাহফিল হবে। আমরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পক্ষে নই। উগ্রতা সৃষ্টির পক্ষে নই। তাই তিনি মাহফিল ছেড়েছেন, মাহফিলে আসবেন না। মাওলানা মামুনুল হককে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাহফিলে বাধা দেয়ার প্রতিবাদে শুক্রবার বায়তুল মোকাররম চত্বরে তৌহিদী জনতার বিক্ষোভ মিছিলে লাঠিচার্জের তীব্র নিন্দা জানিয়ে আমীরে হেফাজত আল্লামা বাবুনগরী বলেন, তৌহিদী জনতার ওপর এমন লাঠিচার্জ বড়ই দুঃখজনক। বিক্ষোভ মিছিল থেকে গ্রেপ্তারকৃতদের আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মুক্তি না দিলে পরামর্শ সাপেক্ষে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করতে বাধ্য হবে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।
এদিকে আল্লামা মামুনুল হককে হাটহাজারী আল আমিন সংস্থার মাহফিলে আসাকে কেন্দ্র করে প্রতিহত করতে গতকাল সকাল থেকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর এলাকায় অবস্থান নিয়েছেন নগর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সেখানে বিক্ষোভ করছেন যুবলীগের কয়েকশ’ নেতাকর্মী। বিকালে নগর ছাত্রলীগের কর্মীদের নগরীর অক্সিজেন মোড়ে, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে হাটহাজারী সড়কের বড়দীঘির পাড় এলাকায় ও হাটহাজারী উপজেলা ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরা ফতেয়াবাদ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ১নং গেট এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান করেন। জুমার নামাজের আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ১নং গেট হাটহাজারী মহাসড়ক এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সড়ক অবরোধ করে ও সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে অগ্নিসংযোগ করেন। এতে মুহূর্তে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং মাহফিলকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর ছিল।
ফয়জুল-মামুনুল সমর্থকদের বিক্ষোভে বাধা, আটক ১০: রাজধানীর নাইটিংগেল এলাকায় তৌহিদী জনতার ব্যানারে দুই ইসলামী দলের সমর্থকরা বিক্ষোভ করার চেষ্টা করেছে। এ সময় পুলিশ তাদের ধাওয়া ও লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ ঘটনায় ১০ জনকে আটক করেছে পুলিশ।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, কয়েকদিন আগে ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামে একটি সংগঠন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মামুনুল হক ও চরমোনাইয়ের জেষ্ঠ্য পীর সৈয়দ ফয়জুল করীমের কুশপুত্তলিকা দাহ করে। এ ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজের পর তৌহিদী জনতার ব্যানারে তাদের সমর্থকরা একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। পুলিশ সদস্যরা মিছিলটিকে প্রথমে বাধা দেয়। কিন্তু, তাদের বাধা পেরিয়ে মিছিলটি বিজয়নগরের দিকে এগোতে থাকে।
পরে নাইটিংগেল মোড়ে পুলিশ লাঠিপেটা ও ধাওয়া দিয়ে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়। সেখান থেকে পুলিশ ১০ জনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পুলিশের ওপর হামলা এবং সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে রমনা থানায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছেন।
বিক্ষুব্ধ এক শিক্ষার্থী রহিম উল্লাহ শেখ জানান, কয়েকদিন আগে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামে একটি সংগঠন চরমোনাইর পীর ফয়জুল করীম এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মামুনুল হকের বিরুদ্ধে কটূক্তি করে। তারই প্রতিবাদে আমরা মিছিল বের করলে আমাদের ওপর পুলিশ অতর্কিত হামলা চালিয়েছে। আরেক শিক্ষার্থী দাবি করেন, শুধু নাইটিংগেল মোড়ে নয় ঢাকার একাধিকস্থানে পুলিশ মিছিলে বাধা দিয়েছে।
এ বিষয়ে পুলিশের মতিঝিল জোনের এসি জাহিদুল ইসলাম সোহাগ জানান, বায়তুল মোকাররম এলাকায় কোনো দল মিছিল করলে নিরাপত্তার জন্য আমাদের আগে তারা জানায়। সেখানে শক্তভাবে পুলিশি নিরাপত্তা দেয়া হয়। কিন্তু, গতকাল কিছু দুস্কৃতিকারী কোনো রকম অনুমতি ও নির্দিষ্ট দলের ব্যানার ছাড়াই মিছিল বের করে। পুলিশ তাদের থামাতে চাইলে তারা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। তখন পুলিশ তাদের ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তিনি জানান, মিছিলে কয়েকজন চেনা মুখ ছিল বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। রমনা জোনের পুলিশের এসি এসএম শামীম জানান, মিছিল থেকে আটক ১০ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।