মৃত্যুকে জয় করতে চেয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

Slider ফুলজান বিবির বাংলা


মানুষের জীবনে অমোঘ, অনিবার্য মৃত্যু। অথচ সেই মৃত্যুকে জয় করতে চেয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বলেছিলেন, মৃত্যুর কথা ভাবা মানে তো জীবনের কাছে পরাজয় স্বীকার করা। আমি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, হারতে তো শিখিনি। সৌমিত্র দার সঙ্গে তিনটি দেড়ঘন্টার টেলিভশন ইন্টারভিউ এর একটিতে আমার প্রশ্ন ছিল, মৃত্যুকে কি ভাবে দেখেন? জবাবে ওই কথাগুলো তিনি আমাকে বলেছিলেন। অথচ সেই মৃত্যর কাছেই হার মানতে হল তাঁকে। আত্মসম্পর্পন করতে হল। ঈশ্বর বোধহয় বুঝিয়ে দিলেন, মৃত্যুকে হার মানাতে পারেনা কেউই।

মৃত্যুই একমাত্র অপরাজেয়। তবে, জীবনের শেষ কাজের দিনটিতেও জীবনের জয়গান গেয়েছেন সৌমিত্র দা। এখানেই হয়তো তাঁর জয়। উনিশশো পঁয়তিরিশ এর উনিশ জানুয়ারী শিয়ালদহের কাছে মির্জাপুরে তাঁর জন্ম। অল্পবয়সেই চলে যান কৃষ্ণনগরে। সেখান থেকে হাওড়া জিলা স্কুল, সিটি কলেজ হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নিয়ে স্নাতকোত্তর। আইনজীবী বাবা সরকারি কর্মী। শখের থিয়েটার এ অভিনয় করতেন। সৌমিত্রর রক্তেও অভিনয় ছিল। এম এ পড়ার সময় অহীন্দ্র চৌধুরীর কাছ থেকে তালিম নেন। শিশির ভাদুড়ির সঙ্গে অভিনয় করেন। কিন্তু অহীন্দ্র চৌধুরী ঘরানাই তাঁর পছন্দ ছিল। আমাকে বলেছিলেন, আমি নিজেকে অহীন্দ্র চৌধুরীর ছাত্র বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসি। অনেকেই জানেন না উনিশশো ছাপ্পান্নতে সত্যজিৎ রায় সৌমিত্রকেই অপরাজিত এর জন্যে মনোনীত করেও পিছিয়ে যান সৌমিত্রর বয়েস কুড়ি পেরিয়ে গেছেন শুনে। উনিশশো ঊনষাট এ অপুর সংসারে সৌমিত্র প্রথম ব্রেক পেলেন। এরপর সত্যজিতের চোদ্দটি ছবিতে তিনি নায়ক। অসাধারণ সব ছবি। সৌমিত্র আর সত্যজিতের যুগলবন্দি। সৌমিত্র দা আমাকে বলেছিলেন, উনি জানতেন আমার মধ্যের সেরাটা কি ভাবে বের করে আনতে হয়। সৌমিত্র আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। অনেকে পঁচাশি বছর বয়েসে তাঁর কাজ করা নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। কিন্তু, তাঁরা জানেন না সংসার প্রতিপালন করার জন্যে সৌমিত্র দাকে কাজ করে যেতে হয়েছে। দুর্ঘটনায় প্রায় পঙ্গু নাতির ওষুধের খরচ জোগাতেই হিমশিম হয়েছেন। পাঁচ দশ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি প্রধান অতিথি হতেও রাজি হয়েছেন। দুহাজার চার এ পদ্মভূষণ, দুহাজার ছয় এ জাতীয় পুরস্কার, দুহাজার বারোতে দাদাসাহেব ফালকে এবং দুহাজার আঠারোতে ফ্রান্সের সর্বোচ্য সম্মান লিজিও ড অনার এ ভূষিত অভিনেতার কি করুন পরিণতি। সত্যজিৎ মৃনাল সেনের নায়ক টাকার জন্যে থার্ড গ্রেড ছবিতেও অভিনয় করতে বাধ্য হলেন। কিন্তু, সেখানেও তিনি সিরিয়াস। এমনই ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাঙালি বারবার সৌমিত্র – উত্তম কাল্পনিক যুদ্ধে উত্তেজিত হয়েছে, আমার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সেই মিথ ভেঙেছেন সৌমিত্র। বলেছেন, আমাদের সম্পর্ক ছিল দাদা ভাইয়ের, আমি ওঁর অভিনয়ের গুণগ্রাহী ছিলাম। কি স্টারডম, ভাবা যায়না। অনেকদিন টেলিফোন করে রাতে উনি আমাকে বলেছেন, পুলু, তৈরি থাকিস লং ড্রাইভে যাবো। ডায়মন্ডহারবার পর্যন্ত লং ড্রাইভ. তারপর পান ভোজন। সে এক অভিজ্ঞতা। উত্তম দা হাতে ধরে কত কি যে শিখিয়েছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একাধারে অভিনেতা, কবি, লেখক, সম্পাদক, চিত্রনাট্যকার, নট, অঙ্কন শিল্পী- একের মধ্যে কত গুনের সমাহার. নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে তাঁর সম্পাদিত এক্ষন পত্রিকার কথা কে ভুলে যাবে? এই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পঁচাশি বছর বয়েসে চলে গেলেন। সত্যিই যেন যুগাবসান হল। আজ তাঁর সেই ভিডিওটার কথা বড় বেশি করে মনে পড়ছে…. পুলু, কেমন আছিস? হয়তো পুলু সত্যিই ভালো নেই কিংবা পুলু হয়তো এমন দেশে পৌঁছে গেছে যেখানে সবাই ভালো থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *