ঢাকা: মাইন্ড এইড হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার সর্বশেষ কর্নারের কক্ষটি ফোমের ঘর নামে পরিচিত। সেটির দেয়ালে ফোম লাগানো। এটি ছিল রোগীদের জন্য আতঙ্কের ঘর। কোনো রোগী কথা না শুনলে তাকে ৮-১০ জন ওয়ার্ডবয় মিলে নেয়া হতো ফোমের ঘরটিতে। এখানেই মূলত চিকিৎসার নামে করা হতো নির্মম প্রহার। মারধর। এটাকে তারা মারধর নয়, বলতেন ট্রিটমেন্ট!
সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিম হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য জানতে পেরেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। সূত্র জানায়, হাসপাতালের দোতলার বারান্দা ঘেঁষা ছোট্ট কক্ষ।
১০ ফুট বাই ৬ ফুটের কক্ষটিতে ফ্লোরে দুটি ফোমের ম্যাট্রেস ফেলা ছিল। লাইট বন্ধ করলেই অন্ধকার। একটি দরজা, কোনো জানালা বা ভেন্টিলেটর নেই। দরজা বন্ধ করে রাখলে বাইরের আলো-বাতাস সেখানে প্রবেশের কোনো উপায় নেই। বিশেষ কায়দায় তৈরি এই কক্ষের দরজা বন্ধ করলে ভেতরে সর্বোচ্চ শব্দ করলেও বাইরে থেকে কিছু শোনা যায় না। কক্ষে একটি এসি ও সিসি ক্যামেরা রয়েছে। এই কক্ষটিতেই নির্যাতনে আনিসুল করিমের মৃত্যু হয় বলে স্বজনদের অভিযোগ। মেঝেতে দুটি জাজিম থাকলেও নেই কোনো বালিশ বা বিছানা চাদর। কোনো রোগীকে বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে আটকে রাখলে ভেতরের কোনো শব্দ বাহিরে পৌঁছায় না। চিকিৎসার নামে রোগীদের নিয়ে আসার পর পরই এই বিশেষ কক্ষে বন্দি করে রাখা হতো।
কোনো রোগী অস্বাভাবিক আচরণ করলে ওই কক্ষে ঢুকিয়ে মারধর করা হতো। ভেতরে বসে চিৎকার করলেও বাইরে থেকে কেউ শুনতে পাবে না। এমনই একটি বিশেষ কক্ষে চিকিৎসার নামে শুরুতেই সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম শিপনকে আটকে রাখতে চেয়েছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পর্যবেক্ষণের নামে এমন বিশেষ কক্ষে মাদকাসক্ত ও মানসিক স্বাস্থ্যের রোগীদের ১০ থেকে ১৫ দিন আটকে রাখা হয়। রোগীরা দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার পর এখান থেকে বের করা হয়। এরপর ওয়ার্ডে বা অন্য কক্ষে দেয়া হয়। কক্ষটিতে থাকতে না চাইলে রোগীদের ওয়ার্ডবয়রা মারধর করে। অথবা বিশেষ এক ধরনের জ্যাকেট পরিয়ে মেঝেতে ফেলে রাখে। এই বিশেষ জ্যাকেট পরলে রোগীরা হাত-পা ছোটাছুটি করতে পারে না। সোজা হয়ে একভাবে পড়ে থাকে। ছোট্ট এই কক্ষে একাধিক রোগীকে ফেলে রাখা হতো। একসঙ্গে চার থেকে পাঁচজনকেও আটকে রাখা হয় বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র। সূত্র জানায়, যারা প্রথম এখানে ভর্তি হয়, তাদের এই কক্ষে এনে আটকে রাখা হয়। প্রস্রাব, পায়খানা সব এই কক্ষেই করেন। তা পরবর্তীতে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা পরিষ্কার করে। গ্রেপ্তারকৃত পলাশসহ একাধিক ওয়ার্ডবয় জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, এএসপি আনিসুল করিমকে মারধরের পর রুমটির মেঝে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা হয়। আনিসুল করিম বমি করলে পরবর্তীতে পানি দিয়ে তা পরিষ্কার করা হয়। এছাড়া পলাশ সেদিনের ঘটনার নির্মম বর্ণনা দিয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের।
নিচতলায় পেছনের দিকে একটি কক্ষে কম্পিউটার ও সাউন্ড সিস্টেম কক্ষ রয়েছে। রোগীকে মারধরের সময় সেখানে উচ্চ শব্দে গান বাজানো হতো। যাতে তাদের চিৎকারের শব্দ হাসপাতালের বাইরে থেকে শোনা না যায়। বাইরে থেকে কোনো কিছু বোঝা যেতো না। এ ছাড়া, হাসপাতালের কোনো রোগী ঘুমাতে না চাইলে ইনজেকশন দেয়া হতো। রাতে জেগে থাকা রোগীর জন্য অন্যদের অসুবিধা হতে পারে ভেবে জেগে থাকা রোগীকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ানো হতো। জানা গেছে, প্রায় দুই বছর আগে হাসপাতাল ভবনের মালিক জাফর আহমেদ মারা গেলে তার ছেলেরা ভবনটিকে হাসপাতাল হিসেবে ভাড়া দেয়। ভবনের মালিকপক্ষ থাকেন গুলশানে। মাইন্ড এইড হাসপাতালটিতে চিকিৎসার জন্য সার্বক্ষণিক বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক থাকতেন না বললেই চলে। হাসপাতালটিতে নিজস্ব চিকিৎসক ছিলেন পাঁচজন। এবং নার্স-ওয়ার্ডবয়সহ কর্মচারী ছিলেন ১৩ থেকে ১৪ জন। হাসপাতালটি মালিক ও পরিচালনা কমিটির সদস্য মো. নিয়াজ মোর্শেদ, আবদুল্লাহ আল মামুন, সাখাওয়াত হোসেন, সাজ্জাদ আমিন ও ফাতেমা খাতুন দীর্ঘদিন ধরে মানসিক চিকিৎসা দেয়ার নামে অর্থ উপার্জনের জন্য অবৈধ ও অসৎ উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন।
আনিসুল হত্যাকাণ্ডের পর হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মচারীদের সকল তথ্য মুছে এবং সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে জানায় তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র। সূত্র জানায়, ওয়ার্ডবয় সাইফুল ইসলাম পলাশ একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষে হঠাৎ করে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। তার বোন ওই হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে চাকরির সুবাদে সেখানে মানসিক রোগী পলাশকে চিকিৎসা করাতে ভর্তি করা হয়। তিন থেকে চার মাস আগে তাকে মানসিক রোগী থেকে সুস্থ বলে ছাড়পত্র দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু রহস্যজনকভাবে পলাশ হাসপাতালটিতে কোনো নিয়োগ ছাড়াই ফুটফরমায়েস খাটতেন। ঘটনার দিন আনিসুলকে মারধরে পলাশ নিজেও সরাসরি অংশ নেয়।
সূত্র জানায়, মাইন্ড এইড সাইকিয়াট্রি অ্যান্ড ডি-অ্যাডিকশন নামের বেসরকারি এই হাসপাতাল মাদকাসক্ত নিরাময়কেন্দ্র হিসেবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়েছিল। তবে চিকিৎসা হতো মানসিক রোগের। এ ধরনের চিকিৎসার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। হাসপাতালটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করেছিল, তবে অনুমোদন পায়নি। পুরুষ রোগীদের ওয়ার্ডবয়রা দেখাশোনা করতেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয়তলায় পুরুষ রোগীদের এবং নিচতলায় নারী রোগীদের রাখা হতো।
গত সোমবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে এএসপি আনিসুল করিম শিপনকে তার ছোট ভাই রেজাউল করিম ও ছোট বোন ডা. উম্মে সালমা সাথীসহ পাঁচ-ছয়জন মিলে আদাবরের মাইন্ড এইড মাদক নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যান।
মাদক নিরাময় কেন্দ্রের নিচতলার বামপাশে একটি কক্ষে ডক্টর চেম্বার এবং অপর কক্ষে ভর্তি কাউন্টার। এখানে বসেই মাদক নিরাময় কেন্দ্রের মালিক ও ম্যানেজার মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয়, কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির ও চিকিৎসক নুসরাত ফারজানা এএসপি আনিসুলকে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু করেন। আনিসুল নিচতলার একটি কক্ষে বসে সকালের নাস্তা করেন। তিনি এ সময় মাদক নিরাময় কেন্দ্রের সবার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করেন। আনিসুল নাস্তা শেষে ওয়াশরুমে যেতে চান। কিছুক্ষণ পর ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয় তাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে দোতলায় নিয়ে যান। আনিসুল হেঁটেই তাদের সঙ্গে উপরে যান। ঘটনার দিন হাসপাতালটিতে ১৪ জন রোগী ছিলেন। পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুর পরপরই ১৩ জন চলে গেছেন।
এতে হাসপাতালটির মালিক ও পরিচালনা কমিটির সদস্যসহ ১৫ জনকে আসামি করা হয়। পুলিশ হাসপাতালটির মালিকদের একজনসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এরমধ্যে ১০ জনকে সাত দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। আনিসুল করিমের বাবার করা মামলার বিবরণে বলা হয়, চারদিন ধরে আনিসুল কারও সঙ্গে কোনো কথা বলছিলেন না। পরিবারের সকলের সঙ্গে আলোচনা করে গত সোমবার তাকে ঢাকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই দিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে মাইন্ড এইড হাসপাতালে নেয়া হয়। একপর্যায়ে আনিসুল ওয়াশরুমে যেতে চান। তখন হাসপাতালের তিন কর্মী তাকে দোতলায় নিয়ে ভেতরে কলাপসিবল গেট লাগিয়ে দেন। বিবরণে আরো বলা হয়, হাসপাতালের ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অজ্ঞাত আরো কয়েকজন চিকিৎসা করার নামে তাকে মারতে মারতে বিশেষ কক্ষে ঢোকান। আনিসুল করিমকে জোর করে উপুড় করে ফেলে একাধিক ব্যক্তি মিলে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরেন। পিছমোড়া করে বেঁধে কনুই দিয়ে পিঠ, ঘাড়সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করেন। কিছুক্ষণ পর আনিসুল নিস্তেজ হয়ে পড়েন।
এদিকে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিম হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দ্রুত দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন ডিএমপি’র তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) হারুন অর রশীদ। গতকাল দুপুরে আনিসুল করিমের গাজীপুরের বাসায় গিয়ে এ কথা জানান ডিসি হারুন। এ সময় তিনি নিহতের পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা ও সহমর্মিতা জানান। এ ছাড়া, আনিসুল করিমের মৃত্যুর ঘটনায় যারা দোষী সাব্যস্ত হবে সবাইকে আইনের আওতায় এনে সুবিচারের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গতকাল সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন। আনিসুলের মৃত্যুর ঘটনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইজিপি বেনজীর আহমেদ। গতকাল দুপুরে এক বার্তায় এ তথ্য জানায় পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগ। এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদাবর থানার পরিদর্শক মোহাম্মদ ফারুক মোল্লা বলেন, হাসপাতালে কতজন চিকিৎসক, নার্স-ওয়ার্ডবয়, কর্মচারী ছিলেন এ সকল বিষয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে পুলিশ হাসপাতালটির মালিকদের একজনসহ মোট ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, হাসপাতালটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র থাকলেও মালিকেরা অবৈধভাবে মানসিক রোগীর চিকিৎসার নামে বাণিজ্য করছিলো।