নবান্ন উৎসবে কেটে যাবে করোনা আঁধার!

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি

হেমন্তেই শুরু হয় নবান্ন উৎসব। এবার প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। করোনা মহামারিতে লন্ডভন্ড সমগ্র পৃথিবী। করোনার প্রথম ঢেউয়ে ঝরে গিয়েছে অসংখ্য প্রাণ। আমাদের দেশেও মৃত্যু বরণ করেছেন ছয় সহস্রাধিক মানুষ। ইতিমধ্যেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সাথে সাথে বাংলাদেশে নবান্ন উৎসবের আগমনি বার্তা।

নবান্নের ধান কাটা আর সেই ধানের প্রথম অন্ন খাওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হয় নবান্ন উৎসব। যেন সত্যি হৃদয়ের বন্ধনকে আরও গাঢ় করার উৎসব। হেমন্ত এলেই বাংলার প্রকৃতি ছেয়ে যায় হলুদ-সবুজ রঙে। এই দেখে কৃষকের মন আনন্দে ভাসতে থাকে। নবান্ন হচ্ছে হেমন্তের প্রাণ। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা হয় পিঠা, পায়েস, ক্ষীরসহ হরেক রকমের খাবার। বাড়ির আঙিনা নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে ভরে ওঠে। কবির ভাষাতে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল, প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে-থেকে আসিতেছে ভেসে, পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাড়ারের দেশে।’

নবান্ন উৎসব জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতায়, ‘আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়, হয়তো মানুষ নয় হয়তো শঙ্খচিল শালিখের বেশে, হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে’।

প্রকৃতির বিচিত্র এ রূপের বর্ণনা দিয়েছেন এদেশের সব কবি-সাহিত্যিক। কুয়াশায় আচ্ছন্ন চারদিক আর কৃষকের গোলায় উঠছে পাকা ধান। চিরায়ত বাংলার চিরচেনা রূপ এটি। কৃষকের মাঠে এখন সোনারাঙা ধানের ছড়াছড়ি।
সারা দেশেই আমন ধান কাটার উৎসব শুরু হয়ে গেছে। কৃষক রাশি রাশি ভারা ভারা সোনার ধান কেটে নিয়ে আসে ঘরে। ধান ভাঙার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে, ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা।

অবশ্য যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন আর ঢেঁকির তালে মুখরিত হয় না। তারপরও নতুন চালের ভাত নানা ব্যঞ্জনে মুখে দেওয়া হয় আনন্দঘন পরিবেশে। তৈরি হবে নতুন চালের পিঠা, ক্ষীর-পায়েস। কৃষক-কৃষাণীরা নবান্নের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেবেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।দেশের কোনও কোনও অঞ্চলে নবান্নে বাড়ির জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়। মেয়েকেও বাপের বাড়িতে ‘নাইয়র’ আনা হয়। নবান্ন আর পিঠেপুলির উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই।

নবান্ন উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন হল মেলা। হরেক রকমের দোকান নিয়ে বসে গ্রামীণ মেলা। তবে গ্রামীণ মেলা এখন আর শুধু গ্রামেই হয় না, শহরেও ব্যাপকভাবে আয়োজিত হয়। এই মেলায় পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের পিঠা, মিষ্টি, সন্দেশ, মন্ডা-মিঠাই, খেলনা-পুতুল,
মাটির জিনিসপত্র আর বসে বাউল গানের আসর। নবান্ন উৎসবকে ঘিরে গ্রাম-গঞ্জে সব শ্রেণীর মানুষের ঢল নামে। নাচ আর গানে মুখরিত হয় মেলা প্রাঙ্গণ। প্রকৃতি আর পরিবেশের মধ্যে আত্মহারা হয়ে ওঠে বাঙালিরা। ‘এসো মিলি সবে নবান্নের উৎসবে’ এই স্লোগান সামনে রেখে প্রতিবছরের মতো এবারও নগরে নবান্ন উৎসব পালিত হয়েছে। এই সময়ে কৃষকের ঘরে নতুন ফসল আসে, সোনালি ফসলে ভরে ওঠে কৃষকের গোলা। ঘরে থাকে খুশির আমেজ, আর সেই খুশির বহিঃপ্রকাশ ঘটে নবান্ন উৎসবের মাধ্যমে।

আবহমান কাল থেকে নবান্নের এ শুভক্ষণে উৎসব-আনন্দে পূজা-পার্বণে মেতে ওঠে বাঙালি। শিল্পায়ন ও নগরায়ণের কশাঘাতে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার আনন্দময় সরল জীবন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তরুণ প্রজন্মের ওপর পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রবল প্রভাব। তবু নাগরিক জীবনে নবান্নের শুভক্ষণের শুভ ছায়া ছড়িয়ে দিতে অগ্রহায়ণের প্রথম দিনে আয়োজন করা হয় নবান্ন উৎসব।

‘গ্রামে যে নবান্ন উৎসব করা হয়, সেটাই প্রধান ও আসল নবান্ন উৎসব। যেখানে আমরা নতুন ধানকে স্পর্শ করতে পারি। খেতে পারি নানা রকম মুখরোচক পিঠা। সে হিসেবে শহুরে জীবনে যে নবান্ন উৎসব করা হয়, সেটা তো প্রতীকী। আমরা যাতে আমাদের উৎসকে ভুলে না যাই সে জন্যই এ আয়োজন।

মোঃ ইসমাঈল হোসেন (মাস্টার)
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক,
এম এ বারী শিক্ষা পরিবার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *