হুঁশ ফিরে এলে আবার মারতো, বলতো, নিউজ করবি কিনা বল শালার পুত

Slider টপ নিউজ


চট্টগ্রাম: নিউজ আর করবো না, আমাকে ছেড়ে দেন। প্লিজ আমাকে আর মারবেন না। এমন আর্তি সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারের মুখে।
গত রোববার রাত ৯টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডু উপজেলার কুমিরা বাজারের পাশে একটি খাল থেকে অবচেতন অবস্থায় সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারকে খুঁজে পায় স্থানীয় লোকজন।

এমন তথ্য জানান বাজারের একটি ডেকোরেশনের মালিক কফিল উদ্দিন। তিনি জানান, উদ্ধার করে তাকে ডেকোরেশনের দোকানে আনা হয়। সেখানে তাকে দোকানের ফ্লোরে অচেতন অবস্থায় শুইয়ে রাখা হয়। সেখানে জড়ো হন অনেক লোক।
হাজির হন পুলিশ, গণমাধ্যমকর্মীসহ অনেকে।

একপর্যায়ে তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নেয়ার জন্য শোয়া থেকে তোলার চেষ্টা করে লোকজন। এ সময় হঠাৎ পা জড়িয়ে তিনি বলতে থাকেন, ভাই আমারে মাইরেন না। আমি আর নিউজ করবো না। আমাকে ছেড়ে দেন। এ সময় লোকজন তাকে আশ্বস্ত করেন যে, তারা তাকে বাঁচাতে সহায়তা করছে। কিন্তু সেদিকে তার হুঁশ নেই।

কফিল উদ্দিন বলেন, অনেক কষ্টে ধরাধরি করে গোলাম সরোয়ারকে হাসপাতালে নেন তারা। বর্তমানে সেখানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি।
সীতাকুণ্ডু থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুমন বণিক জানান, গোলাম সরোয়ার অসুস্থ আছেন। তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হচ্ছে না। তার জ্ঞান ফেরার পর কথা বলে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার সকালে নগরীর ব্যাটারি গলির বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন অনলাইন নিউজ পোর্টাল সিটিনিউজ বিডির নির্বাহী সম্পাদক ও সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার চট্টগ্রাম ব্যুরোর স্টাফ রিপোর্টার সাংবাদিক গোলাম সরোয়ার। এ ব্যাপারে তার প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক জুবায়ের সিদ্দিকী কোতোয়ালি থানায় একটি জিডি করেন।

নিখোঁজের দু’দিন পর তার মোবাইল নম্বর থেকে সাংবাদিক জুবায়ের সিদ্দিকী ও দুই সহকর্মীর মুঠোফোনে কল আসে। কিন্তু নম্বর ট্রেস করতে না পারায় তার অবস্থান শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। এ নিয়ে চট্টগ্রামের সাংবাদিকরা প্রেস ক্লাবের সামনে বিশাল মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। সেখান থেকে সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধারে ১৬ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়া হয়।

সর্বশেষ রোববার সকালে নগরীর দামপাড়ায় সিএমপি কমিশনার কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে সাংবাদিকরা। এরপর রাত ৯টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশ থেকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে গোলাম সরোয়ারকে হাসপাতালে নিয়ে যায় স্থানীয়রা।

সাংবাদিক সরোয়ারের মুখে নির্যাতনের বর্ণনা: পুরো শরীরে বেতের আঘাত। বাদ যায়নি পায়ের তালুও। মার সহ্য করতে না পেরে আমি বারবার মূর্ছা যেতাম। হুঁশ ফিরে এলে আবার মারতো তারা। বলতো, নিউজ করবি কিনা বল শালার পুত। এভাবে গালিও দিত। আমি বারবার তাদেরকে বলেছি, আমি নিউজ আর করবো না, সাংবাদিকতাও ছেড়ে দিব। কিন্তু তারা সেটি শুনতো না। শুধু মারতে থাকতো।

সোমবার (২ অক্টোবর) সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারের মুখে লোমহর্ষক এমন নির্যাতনের কথা উঠে এলো। এ সময় তার দুই চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল। সারোয়ার বলেন, আমি বার বার জিজ্ঞেস করেছি, কোন নিউজের জন্য আমাকে মারছ? কিন্তু সে নিউজের নাম তারা একবারও বলেনি। আমার পা বাধা ছিল। চোখ বন্ধ ছিল। কানেও তুলাজাতীয় বস্তু দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল। তবুও ট্রেন চলাচলের শব্দ শুনতাম। এই সময়ে আমাকে খেতে দিত। শুধু পাউরুটি আর পানি। প্রতিটি ক্ষণ মনে হয়েছিল আমি এখনই মারা যাবো। তারাও একে অপরকে বলছিল মেরে ফেলে দিই। কিন্তু অপরজন বলছিল মেরে ফেলা স্যারের নিষেধ আছে। এ সময় টেলিফোনে তাদের কেউ একজনকে বলতে শুনেছি, সাংবাদিকদের শিক্ষা দেয়ার জন্য তাকে (আমাকে) তুলে এনেছি, হত্যার জন্য নয়। ও সাংবাদিক খবরদার ওকে হত্যা করা যাবে না। এমন কথা মোবাইলে বলতে শুনেছি।

কান্না জড়িত কণ্ঠে সরোয়ার বলেন, তারা ঘণ্টায় ঘণ্টায় আমাকে পেটাতো। টর্চার সেলে লোক ছিল ৫ জন। এদের মধ্যে তিনজন ঢাকার ভাষায় কথা বলতো। দুজন কথা বলতো চট্টগ্রামের ভাষায়। তুলে নেয়ার দিন কিলঘুষিও মেরেছিল। কিন্তু বৃহসপতিবার সকাল থেকে শুরু হয় ঘণ্টায় ঘণ্টায় নির্যাতন। নির্যাতনের ফাঁকে ফাঁকে শুধু একটি কথায় বলতো নিউজ করবি কিনা বল। নির্যাতনকারীরা এমন কথাও বলেছে তাকে যে, এখন সাংবাদিকদের কোনো বেইল (গুরুত্ব) নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *