তুচ্ছ কারণে বা সন্দেহের বশে মানুষকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা থামছেই না। প্রায়শই ঘটছে এই ধরনের ঘটনা। অপরাধ বিজ্ঞানী, আইনবিদ ও মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন, বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার কারণেই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গণপিটুনিতে বাংলাদেশে প্রায় ৮০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যার কোনোটায় ছেলেধরা বা ডাকাত সন্দেহে, আবার কোনো কোনো ঘটনায় সামান্য চোর সন্দেহেও পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে বলছে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সারা দেশে গণপিটুনিতে অন্তত ৩০ জন নিহত হয়েছেন। এরমধ্যে ঢাকা জেলায় ৯ জন। ২০১৮ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৩৯ জন।
২০১৯ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৬৫ জন। গত বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত প্রথম সাত মাসেই নিহত হয়েছেন ৫৩ জন। গত বছর গণপিটুনিতে হত্যার সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম বিভাগে। ২৫ জন মারা গেছেন সেখানে। ঢাকায় নিহত হয়েছেন ২২ জন। এরমধ্যে ২০১১ সালের ১৭ই জুলাই সাভারের আমিনবাজারে ডাকাত সন্দেহে ৬ ছাত্রকে গণপিটুনিতে হত্যার পর সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। এ ঘটনায় এখনো বিচার পায়নি নিহতদের পরিবার।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, চতুর্দিকে সহিংস অপরাধ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। গণধর্ষণ ও গণপিটুনির মতো প্রকাশ্য অপরাধগুলো নিঃসন্দেহে একটি বেপরোয়া অপরাধ প্রবণতার লক্ষণ। আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং দেশ পরিচালনায় আইনের শাসনের অভাব ও দুর্বলতা থেকেই এগুলো হচ্ছে। সরকারের ভূমিকার বড় পরিবর্তন না হলে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা আরো বাড়বে। সেই সঙ্গে বাড়বে আমাদের নিরাপত্তাহীনতা।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, আমাদের দেশে আইন আছে, সংবিধান, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আছে। আইন কখনো কেউ নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না। গণপিটুনি সম্পূর্ণ আইন বহির্ভূত কাজ। যারা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকবে এবং এর জন্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে সেজন্য তারা কিন্তু অন্য হত্যাকাণ্ডের মতো একইভাবে দোষী হবে। এবং সেটা একটি কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এডভোকেট এলিনা খান বলেন, কোনো সময় কোনো আইন হাতে তুলে নেয়াকে আমরা সমর্থন করি না। সেটা জনগণ হোক বা অন্য কেউ। এটা গ্রহণযোগ্য না। গণপিটুনি এটা খুবই ভয়াবহ এবং জঘন্য একটি ঘটনা। তিনি বলেন, ধর্মের নামে কাউকে হত্যা করে পুরিয়ে ফেলার অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি। অপরাধ করলে দেশে প্রচলিত আইন আছে। বিচার ব্যবস্থা আছে। এটা অবশ্যই নিন্দনীয়। এটা বন্ধে আইনের আশ্রয়ের বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা সচেতনতা তৈরি করতে না পারলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
অপরাধ বিজ্ঞানী তৌহিদুল হক বলেন, আমরা প্রায়শই দেখি জনগণ নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে তাদের ক্ষোভ বা আক্রোশ প্রশমিত করতে গিয়ে যে ব্যক্তির প্রতি ক্ষোভ ও আক্রোশ থাকে তাকে হত্যা করছে। কখনো কখনো তারা হত্যা করেও ক্ষান্ত হচ্ছে না। পুড়িয়ে দেয়াসহ অন্য উপায়ে ক্ষোভ প্রশমিত করছে। প্রত্যেকটি ঘটনার ক্ষেত্রেই আমাদের এখানে সামাজিকভাবে কিংবা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে একধরনের অসহিষ্ণু আচরণ আমরা সব সময় লক্ষ্য করি। আমাদের প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিসহ সকলেই এটিকে রাজনৈতিক নয়, মানবিকভাবে, সামাজিক এবং একটি মানুষের অধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা করে সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারলে তবেই বন্ধ করা সম্ভব।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ওয়ালিদ হোসেন বলেন, এ ধরনের ঘটনার বিচার হচ্ছে। বিচারহীনতার মধ্যে আছে এটা বলা যাবে না। বাড্ডার চাঞ্চল্যকর রেনু হত্যা মামলার বিচারের রায় হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন কঠোর অবস্থানে আছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে এ ধরনের হত্যা বন্ধ করা সম্ভব।