বাবা সংসদ সদস্য। নিজে সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর। আছে পারিবারিক ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান। ক্ষমতা আর অর্থের দম্ভে মানুষকে মানুষ ভাবারও সময় ছিল না তার। নিজের বাসাকে পরিণত করেছেন অনেকটা দুর্গের মতো করে। সেখানে আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবহার করে এমন ওয়াকিটকি, হ্যান্ডকাফ, ফ্রিকোয়েন্সি ডিভাইস। মানুষকে ধরে এনে নির্যাতনের জন্য গড়ে তুলেছিলেন টর্চার সেল। তিনি ঢাকা-৭ আসনের এমপি হাজী সেলিম পুত্র ইরফান সেলিম।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের এই কাউন্সিলর রোববার রাতে সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো গাড়িতে দেহরক্ষী নিয়ে বের হয়েছিলেন ধানমণ্ডি এলাকায়। ওই গাড়িটি বেপরোয়াভাবে পেছন থেকে ধাক্কা দেয় নৌবাহিনী কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমেদ খানের মোটরসাইকেলে। স্ত্রীকে নিয়ে ব্যক্তিগত কাজে বের হওয়া ওই কর্মকর্তা ওই গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন মাত্র। এরপর আর তার রক্ষা হয়নি। গাড়ি থেকে নেমে ওই কর্মকর্তার ওপর হামলে পড়েন ইরফান ও তার দেহরক্ষীরা। কিল-ঘুষিতে তার দাঁত ভেঙে দেন। রক্তাক্ত অবস্থায় নিজের পরিচয় দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিলেন তিনি। ওই অবস্থায় ঘটনাস্থল থেকে করা একটি ভিডিও ভাইরাল হলে নিন্দার ঝড় উঠে সর্বত্র। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর অভিযানে নামে র্যাব। আটক করা হয় ইরফানকে। হাজী সেলিমের পৈতৃক বাসায় চলা অভিযানে খোঁজ মেলে ইরফানের অবৈধ সাম্রাজ্যের। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্ষমতার অবৈধ দাপটে ইরফান এমন সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। তার দম্ভ আর ক্ষমতার দাপটে অতিষ্ঠ ছিল এলাকার মানুষ।
যা ঘটেছিল রোববার রাতে: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায় নৌবাহিনী কর্মকর্তার মুখের এক পাশ থেকে রক্ত ঝরছে। স্ত্রীর সামনে তাকে এলোপাতাড়িভাবে পেটানো হচ্ছে। মারধরের শিকার নৌবাহিনী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নিউমার্কেট থেকে বই কিনে মোহাম্মদপুরের বাসায় মোটরসাইকেলে করে স্ত্রীকে নিয়ে ফিরছিলেন তিনি। তার পরনে ছিল জিন্স প্যান্ট ও কালো গেঞ্জি। রাজধানীর ধানমণ্ডিতে রাত আনুমানিক ৮টার দিকে কলাবাগানের ক্রসিংয়ের কাছে পেছন থেকে সংসদ সদস্য স্টিকারযুক্ত কালো রংয়ের গাড়ি তার মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়।
গাড়ি নম্বর: ঢাকা মেট্রো-ঘ ১১-৫৭৩৬)। গাড়িটি সিগন্যাল দিয়ে তিনি থামান। এরপর নিজের মোটরসাইকেল রাস্তার পাশে রেখে ওই কালো গাড়ির কাঁচে নক করেন। তার মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়ার কারণ গাড়িচালকের কাছে জানতে চান। চালক কাঁচের গ্লাস নামিয়ে আবার গাড়ি স্টার্ট করে চলে যেতে চাইছিলেন। অবাক হন ওয়াসিফ। এরপর আবার কিছু দূর গিয়ে গাড়িটির সামনে মোটরসাইকেল থামান। মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়ার কারণ জানতে চান গাড়ির চালকের কাছে? এ সময় ওয়াসিফের স্ত্রী সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি এ সময় নিজের পরিচয় দেন। তখন গাড়ি থেকে নেমেই হাজী সেলিমের ছেলে এরফান, গাড়িচালক মিজানুর ও তার দেহরক্ষী জাহিদ বলতে শুরু করেন থাম, তোর লেফটেন্যান্টগিরি ছুটাচ্ছি। লেফটেন্যান্ট না…। শুরু হয় মারধর। তিনজন সমানতালে তাকে পেটাতে থাকে। এ সময় তিনি চিৎকার দিয়ে তার পরিচয় দিতে থাকেন এবং তাদের আক্রমণ থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে থাকেন। তারা তাকে এলোপাতাড়ি সড়কে ফেলে লাথি, কিল, ঘুষি মারতে থাকে। তিনি বার বার নিজের পরিচয় দিচ্ছিলেন এবং তাকে মারধর করতে নিষেধ করছিলেন। কিন্তু, তাদের কোনো কথাই কানে যায়নি। এলোপাতাড়ি মারধরের একপর্যায়ে তার স্ত্রী সড়কের পাশ থেকে স্বামীকে বাঁচাতে আসেন। কিন্তু, তারা তার স্ত্রীর গায়েও হাত তুলেছে বলে ওয়াসিফ অভিযোগ করেছেন। তাদের মারধরের কারণে ওয়াসিফের মুখের বাম পাশ দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। মারধরের সময় কোনো পথচারী তাৎক্ষণিক সেখানে যায়নি। কিন্তু, ওয়াসিফের আহাজারিতে এবং তার পরিচয় বার বার চিৎকার দিয়ে বলার কারণে এসময় চশমা ও জ্যাকেট পরিহিত দুইজন পথচারী তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। ভিকটিমের কাছে জানতে চান ঘটনা কী হয়েছে? কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি তাদের সব খুলে বলেন। ওই সময় মূল সড়কে খুব বেশি লোকজনের যাতায়াত ছিল না। তবে গাড়ি চলাচল বেশি ছিল। ওই দুইজন পথচারী যখন ভিকটিমের কাছে গেলেন এসময় অন্য পথচারীরা সেখানে এগিয়ে আসেন। এসময় সেখানে জটলা সৃষ্টি হয়। ওয়াসিফ জটলা হওয়া লোকজনের কাছে নিজের পরিচয় দেন এবং তার মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়া হয়েছে বলে এ কথা জিজ্ঞাসার অপরাধে তাকে মারধর করা হয়েছে বলে জানান। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলতে থাকেন, দুর্বৃত্তরা আমার দাঁত ভেঙে ফেলেছে। আমি পরিচয় দেয়ার সময় কোনো পথচারী আমাকে বাঁচাতে আসেনি। জটলার মধ্য থেকে এক অজ্ঞাত পথচারী সেখানকার দৃশ্য ভিডিওতে ধারণ করে। ভিডিওতে দৃশ্যধারণকারী তার কাছে জানতে চান যে, কী ঘটেছে এখানে? এ সময় তিনি ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেন।
তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ। আমি নৌবাহিনীর কর্মকর্তা। এসএসএফ-এর সদস্য ছিলাম। আমি একজন সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা। তিনি বলেন, নিউমার্কেটে বই কিনে স্ত্রীসহ মোটরবাইকে ফিরছিলেন। ওই গাড়িটি তার মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। তিনি তখনই মোটরসাইকেল থামান এবং নিজের পরিচয় দেন। গাড়ি থেকে নেমে তারা তাকে মারধর শুরু করেন। মারধরের কারণে এই দেখেন দাঁত ভেঙে গেছে। তার স্ত্রীর গায়েও হাত দিয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন, তাকে মারধরের পাশাপাশি বলা হয়েছে যে, মেরে ফেলে দে, মেরে ফেলে দে। হত্যার উদ্দেশ্যে তারা আমার ওপর হামলা চালিয়েছে। এসময় তার পাশে থাকা দুই পথচারীকে গাড়ির নম্বর চিহ্নিত করতে দেখা যায়। পাশে আরেক পথচারী চিৎকার দিয়ে বলছিলেন যে, তারা একে মারধর করেছে।
আরেক পথচারী বলেন, তাকে মারা হয়েছে। এটা ঠিক হয়নি। মানুষের জটলা দেখে এবং জনতার রোষানল থেকে বাঁচতে গাড়ির পেছনে থাকা একটি ব্যাগ নিয়ে হাজী সেলিমের ছেলে এবং তার দেহরক্ষী সেখান থেকে গাড়ি ফেলে পালিয়ে যায়। ক্রসিংয়ে জটলা দেখে ট্রাফিক পুলিশ থানা পুলিশের টহল টিমকে খবর দেন। সেখানে ছুটে যান ধানমণ্ডি থানার টহল পুলিশের একটি দল। সিভিল পোশাকে ওই পুলিশের কর্মকর্তা ধানমণ্ডি থানার ইন্সপেক্টর। তার পাশে আরো কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওয়াসিফ যখন ওই ঘটনার প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন তখন তারা সিভিল পোশাকে থাকা ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে মোবাইলের বাটন টিপতে দেখেন, কাউকে ফোন করার চেষ্টা করছিলেন বলে দেখা গেছে।
এসময় নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ ওই পুলিশ সদস্যের কাছে চিৎকার দিয়ে ওই ঘটনার প্রতিবাদ জানান। তাদের তিনি বলেন, তাকে মারধর করা হয়েছে। তারা আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছে। তিনি এর প্রতিবাদ জানান। তার স্ত্রী পুলিশকে বলেন, এই গাড়ি আমাদের মোটরবাইকে ধাক্কা দিয়েছে। কেন ধাক্কা দেয়া হলো তার প্রতিবাদ জানতে চাইলে মারধর করা হয়েছে। চোখের সামনে তার স্বামী এবং সশস্ত্র বাহিনীর একজন কর্মকর্তা পরিচয় দেয়ার পর এমন এলোপাতাড়ি মারধরে তিনি বেশি কথা বলতে পারেননি। ঘটনার পর হতবাক হয়ে তিনি ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন। পুলিশ সেখান থেকে তার মোটরসাইকেল এবং হামলাকারীদের গাড়িটি থানায় নিয়ে আসে।
সূত্র জানায়, এরপর থেকে তাদের দুইজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য নানা মাধ্যমে যোগাযোগ শুরু করে পুলিশ। দুইপক্ষের সঠিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর ভিকটিমকে পুলিশ জানায় যে, তিনি কোনো আইনগত পদক্ষেপ নিবেন কিনা? ভিকটিম পুলিশকে জানান, তিনি শারীরিকভাবে এবং মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত। তিনি এখন বাসায় যাবেন। সকালে এসে তিনি আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়টি জানাবেন। পরে ভোরে এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলা দায়েরের পর অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।