অবরোধেই আসবে কোকোর লাশ

Slider জাতীয়
104479_Tarweque Rahman-03
অবরোধ কর্মসূচির মধ্যেই আসছে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মরদেহ।
মালয়েশিয়া থেকে কাল সকাল ৯টার একটি ফ্লাইটে টিকিট বুকিং দেওয়া হয়েছে। বেলা সাড়ে ১১টার মধ্যেই তার লাশ ঢাকায় পৌঁছার কথা। কাল বাদ আসর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে কোকোর দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। বুধবার সারা দেশে হবে গায়েবানা জানাজা। এর আগে গতকাল মালয়েশিয়া কেন্দ্রীয় মসজিদে কোকোর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রাথমিকভাবে রাজধানীর বনানী সামরিক কবরস্থানে কোকোকে দাফনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। মালয়েশিয়ায় শনিবার দুপুরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আরাফাত রহমান কোকো। তার বয়স হয়েছিল ৪৫ বছর। গুশলান কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এখনো পুত্রশোকে নির্বাক বেগম খালেদা জিয়া। গতকাল দিনভর তিনি কারও সঙ্গে কথা বলেননি। পরিবারের ঘনিষ্ঠজন ছাড়া কাউকে দেখা সাক্ষাৎও দেননি। তার শারীরিক অবস্থাও ভালো নেই বলে জানা গেছে। গতকালও ওষুধ দিয়ে বিএনপিপ্রধানকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। ভিসা জটিলতা কাটিয়ে ছোট ভাইকে দেখতে আজ মালয়েশিয়ায় আসতে পারেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। অন্যদিকে কোকোর ডেথ সার্টিফিকেটও আজ মালয়েশিয়ার সংশ্লিষ্ট কার্যালয় থেকে তোলা হবে। এ ছাড়া তার অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন মালয়েশিয়া বিএনপির সাবেক সভাপতি মো. বাদলুর রহমান খান।
আজ সন্ধ্যা ৬টায় হরতালের সময়সীমা শেষ হলেও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন গন্তব্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ অবরোধ-হরতাল অব্যাহতভাবে চলতে থাকবে।’ দলের একটি সূত্র জানিয়েছে, কোকোকে দাফনের পর বুধ ও বৃহস্পতিবার আবারও হরতাল কর্মসূচি দিতে পারে ২০ দল। গতকাল রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও শিমুল বিশ্বাস পৃথকভাবে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ২০ দলীয় জোটের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। এ সময় সান্ত্বনা জানাতে আসা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের বেগম জিয়ার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানান তারা।কোকোর প্রথম জানাজা : কুয়ালালামপুর থেকে প্রতিনিধি শাহাদাত হোসেন জানান, গতকাল বাদ জোহর বিএনপি  চেয়ারপারসনের ছোট ছেলে আরাফাত রহমানের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে মালয়েশিয়ার কেন্দ্রীয় মসজিদ নাগারায়। কেন্দ্রীয় মসজিদের পেশ ইমামের ইমামতিতে কোকোর জানাজা হয়। পেনাং, পুত্রাজায়া, জোহোর বারু, গ্যানটিং হাইল্যান্ডস, ক্যামেরন হাইল্যান্ডস, বুকিত বিন তানসহ বিভিন্ন স্থান থেকে দশ সহস্রাধিক প্রবাসী বাংলাদেশি ও বিএনপির নেতা-কর্মীরা জানাজায় অংশ নেন। পরে তারা কোকোর কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। ঢাকা থেকে যাওয়া কোকোর মামা শামীম এস্কান্দার, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালু, বরিশাল জেলা বিএনপির সহসভাপতি শরফুদ্দিন আহমেদ সান্টু, সাবেক সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মনি, আলী আজগর লবি, ঢাকাস্থ মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূত প্রমুখ জানাজায় অংশ নেন। পরে কোকোর কফিন আ জে এম হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়। ভাগ্নের মরদেহ আনার জন্য শনিবার রাতেই তিনজন আত্মীয়কে নিয়ে মালয়েশিয়া যান শামীম এস্কান্দার। এদিকে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান, কোকোর বড় মেয়ে জাফিয়া রহমান, ছোট মেয়ে জাহিয়া রহমানও মসজিদ নাগারায় এসেছিলেন। ছোট মেয়ে জাহিয়া রহমান বাবার লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের কান্নায় নাগারার আশপাশ ভারী হয়ে ওঠে। ছোট মেয়ের কান্না দেখে জড়ো হওয়া প্রবাসীরাও কান্না থামাতে পারেননি। সবার চোখে পানি এসে যায়। মেয়ের কান্না থামাতে এগিয়ে আসেন মোসাদ্দেক হোসেন ফালু।শোক বইতে স্বাক্ষর : গতকাল দুপুরের পর থেকে দিনভর শোক বইতে স্বাক্ষর করেন ঢাকাস্থ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। কূটনীতিবিদদের মধ্যে ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন, মিসরের রাষ্ট্রদূত আহমদ আজ্জাদ, ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত শায়ের মোহাম্মদ, ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্স ডেভিড মিলি, ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার সঞ্জীব চক্রবর্তী, ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রিসেন্টের ডারকু জাজ্জালোভ, পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার সামিনা মেহতাব, চীনের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত লিং চু, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত, তুরস্কের রাষ্ট্রদূত, জাপানের রাষ্ট্রদূতসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা শোক বইয়ে স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিকল্প ধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, সাবেক এমপি প্রকৌশলী ফজলুল আজিম, হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির নূর হোসাইন কাশেমী, আবদুর রব ইউসুফী, জাকের পার্টির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এজাজুর রসুল, বিশিষ্ট কলামিস্ট ফরহাদ মজহার প্রমুখ শোক বইয়ে স্বাক্ষর করেন। তবে কেউই শোকাহত বেগম জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেননি। জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পক্ষ থেকেও একটি শোকবার্তা বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে পাঠানো হয়। দলের সহ-দফতর সম্পাদক আবুল হাসান আহমেদ জুয়েল শোকবার্তাটি নিয়ে আসেন এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস তা গ্রহণ করেন। এতে প্রধান দুই নেত্রীকে সংলাপের আহ্বান জানানো হয়েছে। নইলে অনশনে যাওয়ার হুমকিও দিয়েছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির আরেক অংশের চেয়ারম্যান কাজী জাফর আহমেদও গুলশান কার্যালয়ে এসে সমবেদনা জানান। এ ছাড়া বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। এ ছাড়া শত শত নেতা-কর্মী গুলশান কার্যালয়ে দিনভর অবস্থান নেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও ছিল অন্যদিনের তুলনায় কম।পুত্রশোকে নির্বাক খালেদা : ছোট ছেলের মৃত্যুর খবর পাওয়ার ২৪ ঘণ্টা পরও মা বেগম খালেদা জিয়া শোকে এখনো নির্বাক। দল, জোট এবং পরিবারের লোকজন সমবেদনা জানাতে গুলশান কার্যালয়ে গেলে কারও সঙ্গে দেখা দেননি বিএনপিপ্রধান। বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস জানিয়েছেন, কারও সঙ্গেই কথা বলছেন না বিএনপি চেয়ারপারসন। ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সদস্যরা ছাড়া কাউকে তিনি দেখাও দিচ্ছেন না। শিমুল বিশ্বাস আরও বলেন, প্রিয় সন্তানের মৃত্যুতে প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ীতে বাসে আগুন দেওয়ার মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে। বুঝতেই পারছেন তার মনের অবস্থা। এদিকে বেগম জিয়ার সঙ্গে গতকাল দিনভর তার পরিবারের সদস্যরা সময় দেন। ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজের পর বেগম জিয়াকে আবারও ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়। নাওয়া-খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন তিনি। তবে খালেদা জিয়ার সেজো বোন সেলিনা ইসলাম, তার দুই ভাইয়ের স্ত্রী, তারেক রহমানের শাশুড়ি ইকবাল মান্দ বানু ও কোকোর শাশুড়ি দিনভর বেগম জিয়ার সঙ্গে ছিলেন।তিন দিনের শোক : কোকোর মৃত্যুতে তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছে বিএনপি। দলের যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, চেয়ারপারসনের ছেলের মৃত্যুতে আজ থেকে বুধবার পর্যন্ত তিন দিনের শোক পালন করা হবে। এই সময়ে দলীয় সব কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন ও নেতা-কর্মীরা কালো ব্যাজ ধারণ করবে।ডুকরে কাঁদছেন তারেক রহমান : যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি আ স ম মাসুম জানান, ভিসা জটিলতায় মালয়েশিয়া যেতে বিলম্ব হচ্ছে তারেক রহমানের। শনিবার সকালেই ছোটো ভাই কোকোর মৃত্যুর সংবাদে তারেক রহমান কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকেন। এর পরই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। এ সময় তার সহধর্মিণী জোবায়দা রহমান ও একমাত্র কন্যা জায়মা রহমানও কান্নাকাটি শুরু করেন। খবর পেয়ে যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতারা তারেক রহমানের বাসায় ভিড় করেন।লন্ডনে গায়েবানা জানাজা  : লন্ডনে গতকাল স্থানীয় সময় ৩টায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে ও তারেক রহমানের ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর গায়েবানা জানাজা হয়েছে। পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে এ জানাজা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে। জানাজা পড়ান হাফিজ মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান। জানাজার আগে তারেক রহমান তার ভাইয়ের আত্মার শান্তির জন্য সবার কাছে দোয়া চান। জানাজায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র লুৎফুর রহমানসহ স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা অংশ নেন।আওয়ামী লীগের শোক : বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে আওয়ামী লীগ। গতকাল ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের পক্ষে সংবাদ সম্মেলনে প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর অকাল মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি। বেগম জিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। তারা যেন এই শোক কাটিয়ে উঠতে পারেন।বিএনপির উদ্দেশে হাছান মাহমুদ বলেন, আশা করি বিএনপির শুভবুদ্ধির উদয় হবে। কোকোর আত্মার শান্তি কামনা করে তারা তাদের সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করবে। তিনি বলেন, রাজনীতি আমাদের পরিশীলিত ও সৌজন্য বোধ শেখায়। গেট বন্ধ রেখে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে তা রাজনৈতিক কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। এমন ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম। ভবিষ্যতে ঘটবে কি-না জানা নেই। যারা প্রধানমন্ত্রীকে ফটকে যাওয়ার পরও সৌজন্যতা দেখাতে পারেন না, তাদের কোনো কথায়ই সত্যের লেশমাত্র নেই। তিনি বলেন, আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, প্রধানমন্ত্রী গুলশান কার্যালয় ত্যাগ করার পরই খালেদা জিয়া তাকে ধন্যবাদ জানালেন। এটা কেমন ইনজেকশন জানি না।তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী প্রায় ১২ মিনিট গুলশান কার্যালয়ে অপেক্ষা করেন। শিমুল বিশ্বাস নাকি শোক বই নিয়ে এসেছিলেন। খালেদা জিয়ার কার্যালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর দূরত্ব ছিল ৫ গজ। শিমুল বিশ্বাসের ১ মিনিটও লাগার কথা নয়। শোক বইয়ের গল্প এই ন্যক্কারজনক ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা মাত্র।    সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আবদুস সোবহান গোলাপ, আবদুস সাত্তার, বদিউজ্জামান ভুইয়া ডাবলু, ফরিদুন্নাহার লাইলী, অসীম কুমার উকিল, এনামুল হক শামীম, এস এম কামাল, সুজিত রায় নন্দী প্রমুখ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *