সংশয় ছিল শুরু থেকেই। অনেক বিশেষজ্ঞই বলছিলেন, সত্য তথ্য আমাদের সামনে আসছে না। ৮ই মার্চ দিনের কোনো একসময় দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের খবর দেয়া হয়। এর আগে প্রতিদিনই নিয়মিত ব্রিফিং হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশ করোনামুক্ত। এরপর সময় গড়িয়েছে। তথ্য নিয়ে সংশয় হয়েছে আরো প্রকট। কিন্তু কর্তৃপক্ষ যথারীতি অনড় থেকেছেন।
শুরুতে কিছু প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল। একসময় বলা হলো, বাপুরা প্রশ্ন করা নিষেধ। তোমরা কেবল শুনে যাবে। একপর্যায়ে অবশ্য ব্রিফিংও বন্ধ করে দেয়া হয়। এখন কেবল ‘প্রেস নোট’ আসে। সেখানে যা লেখা থাকে তাই পরিবেশন করতে হয় সংবাদ মাধ্যমে।
সরকারি হিসাবে করোনায় এখন পর্যন্ত দেশে ৫ হাজার ৫৭৭ জন মানুষ মারা গেছেন। আর এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত হয়েছেন ৩ লাখ ৮১ হাজার ২৭৫ জন। এটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান। সোমবার করোনা সংক্রমণ ও করোনার জিন নিয়ে একটি গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) যৌথভাবে এই গবেষণা পরিচালনা করে। গবেষণার ফলে দেখা যায়, ঢাকায় ৪৫ ভাগ মানুষের ইতিমধ্যে করোনা হয়ে গেছে। সে হিসাবে ঢাকায় এক কোটির কাছাকাছি মানুষ এরইমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে গেছেন। মনে রাখা দরকার, গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে মধ্য এপ্রিল থেকে আগস্টের শেষ পর্যন্ত। এরপর করোনা আক্রান্তের সংখ্যা আরো বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেছেন, ঢাকা শহরের সংক্রমণের এ তথ্য জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ের। সংক্রমণের ধারা অনুসরণ করলে অনুমান করা যায় আক্রান্তের হার ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশে পৌঁছে গেছে। এক্ষেত্রে নিশ্চিত করেই বলা যায়, আক্রান্তের সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে গেছে। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে আক্রান্তের সংখ্যা চার লাখের কম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মার্চের শুরুতে প্রথম করোনা আক্রান্তের কথা জানায়। অথচ জিন বিশ্লেষণে গবেষকরা বলছেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে দেশে প্রথম করোনা ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটে। বস্তিতে আক্রান্ত নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি ছিল। বলা হয়েছিল, বস্তিতে তেমন সংক্রমণ নেই। কিন্তু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বস্তিতে সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি। বস্তিতে ৭৪ ভাগ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে গেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা সংক্রমণের সংখ্যা নিয়ে সারা বিশ্বেই বিতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে প্রয়োজনের তুলনায় টেস্টের সংখ্যা কম হওয়ায় প্রকৃত রোগীর সংখ্যা জানা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে টেস্টের হার অন্য বেশির ভাগ দেশের তুলনায় কম। যে কারণে প্রকৃত তথ্য প্রায় সবসময়ই জানা যাচ্ছে না। অথচ করোনা মোকাবিলায় রোগী শনাক্তের ওপর শুরু থেকেই জোর দেয়া হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথম থেকেই বলে আসছে, টেস্ট, টেস্ট এবং টেস্ট। এখন দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে শনাক্ত হওয়ার আগেই করোনা বেশ খানিকটা ছড়িয়ে পড়েছিল। অথচ এ ব্যাপারে দায় নিতেও কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে এরইমধ্যে শঙ্কা, নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে এমন গবেষণা করোনার প্রকৃত চিত্র বুঝতে সহযোগিতা করবে। তবে একই সঙ্গে যারা সত্য অস্বীকার করে গেছেন তাদের দায় নেয়া উচিত। আর ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা প্রয়োজন বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে, ‘কম টেস্ট, কম করোনা’- নীতির ভিত্তিতে নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, যে জরিপটি করা হয়েছে এই জরিপের মাধ্যমে একটি জিনিস পরিষ্কার হয়েছে যে, প্রথম থেকেই ঢাকা একটি হটস্পট ছিল। এখনো ঢাকা একটি হটস্পট। এবং যেখানে সংক্রমণের হার অত্যন্ত বেশি। ৪৫ ভাগ মানে অত্যন্ত বেশি। এর আগে করোনা পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা কিন্তু এত সংখ্যায় করোনা আক্রান্ত পাইনি। এটার দ্বারা প্রমাণিত হলো প্রথমদিক থেকেই যখন ঢাকা শহরের সংক্রমণ বেশি ছিল এবং এখনো ঢাকা শহরে সংক্রমণের হার বেশি। এবং এটার মাধ্যমে প্রমাণ করে যে প্রথমত, আমরা যদি টেস্টের আওতাটা ঢাকা শহরে বাড়াতে পারতাম তাহলে প্রকৃত সংক্রমিত লোকের সংখ্যা যেটা মিস (হারিয়েছি) করেছি সেটা পেতে পারতাম। তিনি বলেন, তখন আমাদের সংক্রমণের হার কিন্তু ৩০ থেকে ৩৫ পর্যন্ত পেয়েছিলাম। আর এখন আমরা অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে পাচ্ছি ৪৫ ভাগ। তার মানে ঢাকা শহরে এখনো সংক্রমণের হার বেশি। সুতরাং আমাদের যেটা এখন করতে হবে সেটা হলো এই ধরনের সেরো সার্ভেলেন্স (অ্যান্টিবডি পরীক্ষার জরিপ) সারা দেশব্যাপী হওয়া উচিত। তাহলে আমরা সেখানে সংক্রমণের হার জানতে পারবো প্রতিটি জেলায়। এবং জেলা ভিত্তিক আমরা কৌশল ঠিক করতে পারবো কীভাবে সংক্রমণের হার কমানো যায়। কারণ আমাদেরকে যে কোনো প্রকারেই সংক্রমণের হার ৫ এর নিচে আনতে হবে। এবং সে জন্য আমাদের কৌশল ঠিক করতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদেরকে মনে রাখতে হবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের দু’টি পন্থা। একটি হলো টিকা। আরেকটি হলো টেস্ট করা। এবং টেস্টের মাধ্যমে সংক্রমিত লোকদেরকে আইসোলেশনে নেয়া। চিকিৎসা দেয়া। এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করে স্বাস্থ্যবিধি মানতে জনগণকে এবং প্রতিষ্ঠনাগুলোকে বাধ্য করা। তাহলেই আমরা শুধু করোনার বর্তমান যে সংক্রমণের হার সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো।
প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, গত কয়েক মাস ধরেই বলছি আগে টেস্ট কম হত। টেস্ট অনুযায়ী যে আক্রান্তের সংখ্যা তার প্রকৃত সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। অনেকেই হয়তো আক্রান্ত হয়ে গেছেন। মৃদু লক্ষণ ছিল বা লক্ষণ নেই। অনেকেই আবার এমনি এমনিই ভালো হয়ে গেছে। শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে এ রকম সংখ্যা বেশি মনে হয়। এই জরিপে ঢাকা শহরের সবার টেস্ট করানো হয়নি। তবে আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই এটুকু বলা যায়। প্রচুর আক্রান্ত এতে কোনো সন্দেহ নেই। তার পরেও লক্ষ্য রাখতে হবে অ্যান্টিবডি কিন্তু স্থায়ী না। কতদিন এটা সুরক্ষা দিবে কেউ জানে না। সুতরাং কেউ যেন অ্যান্টিবডির কথা ভেবে উদাসীন ভাব না দেখায়। সকলের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
আইইডিসিআর’র সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, সেরো সার্ভেলেন্স (অ্যান্টিবডি পরীক্ষার জরিপ) জরিপে আক্রান্তের হার এরচেয়ে আরো বেশি হতে পারে। এবং এই অ্যান্টিবডি তিন মাসের বেশি থাকে কি না সেটাই তো প্রশ্ন। এটা দিয়ে বলা যায় অন্ততপক্ষে শতকরা ৪৫ ভাগ মানুষ করোনা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়েছেন। তবে আমাদেরকে আরো বেশি পরীক্ষা করতে হবে। এটা বলা যাবে যাদের মধ্যে থেকে স্যাম্পল নেয়া হয়েছে প্রায় অর্ধেকের মতো আক্রান্ত হয়েছেন। এই অ্যান্টিবডি দিয়ে বর্তমানে আক্রান্তের সংখ্যা জানা যাচ্ছে না। পুরনো আক্রান্তের সংখ্যা জানা যাচ্ছে।