সম্পাদকীয়: লাউ কদু যেন এক না হয়!

Slider সম্পাদকীয়

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মোট ৩৪টি ধারা ছিল। এর মধ্যে ১২টিতেই মৃত্যুদন্ডের বিধান ছিল। এ গুলো হল, ৪, ৫(১),(২),(৩), ৬(১),(২), ৮, ৯(২)(৩), ১১(ক), ১২ এবং ৩০ ধারা। এর মধ্যে ৫ ও ৬ ধারার অপরাধ এসিড নিয়ন্ত্রন ও মাদকপাচার সংক্রান্ত দুটি আইনের অংশ হয়ে যাওয়ায় নারী নির্যাতন দমন আইন হতে দুটি ধারা বাদ পড়ে যায়। ফলে ৩৪ ধারার এই আইনটির ১২টির মধ্যে ৭টি ধারায় মৃত্যুদন্ড বহাল আছে। এখন আইনের ৯(১)-এ শাস্তি সংশোধন করে যাবজ্জীবনের পরবির্তে যাবজ্জীবন অথবা মৃত্যুদন্ড করা হচ্ছে। এতে এই আইনের ৮টি ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড হবে।

চলমান আইনের বিধান হলো, ১৮০ দিনে ধর্ষণ মামলার বিচার শেষ করতে ব্যর্থ হলে বিচারক, পুলিশ ও প্রসিকিউটর যথাক্রমে সুপ্রিম কোর্ট, আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে উপযুক্ত কারণ ব্যাখ্যা (পুলিশ ও প্রসিকিউটরের ব্যাখ্যার অনুলিপি সুপ্রিম কোর্টকে দেওয়া বাধ্যতামূলক) করবেন। সংশ্লিষ্টরা ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট না হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু হাইকোর্ট দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেন, দু-একটা বিরল ব্যতিক্রম বাদে এই বিধানের আদৌ কোনো কার্যকরতা নেই বাস্তবে।

বলা যেতে পারে, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি জে বি এম হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০১৬ এবং ২০১৯ এই তিন বছরের ব্যবধানে ধর্ষণের বিচারে গতি আনতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ রায় দেন। বর্তমান সরকারের আমলে সুপ্রিম কোর্ট, পুলিশ এবং সরকারি প্রসিকিউশন ধর্ষণ দমনে কীভাবে বাস্তবে কাজ করেন, সেটি এতে ফুটে উঠেছে। ২০১৬ সালে মিলাদ হোসেন বনাম রাষ্ট্র মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ ১৮০ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলার বিচার না হওয়া এবং সে কারণে কোনো জবাবদিহি না থাকায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কিন্তু তাতে সংশ্লিষ্টরা একদমই কর্ণপাত করছেন না।

হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ডিসেম্বরেই বলছেন, আমাদের অভিজ্ঞতা হলো যে ধর্ষণসংক্রান্ত মামলার আসামিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেপরোয়া ও দুর্দান্ত। তারা বিভিন্ন ধরনের অপকৌশল অবলম্বন, ক্ষেত্রবিশেষে সামাজিক বিচার করে ভিকটিম পরিবারকে মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য এবং আদালতে সাক্ষ্য প্রদানে বিরত থাকতে চাপ দিয়ে থাকে। তাই হাইকোর্ট বলেন, আমাদের সুচিন্তিত অভিমত এই যে অবিলম্বে সাক্ষী সুরক্ষা আইন তৈরি হোক। সেই আইন কেউ দিচ্ছে না।

উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ধর্ষণের মাধ্যমে হত্যার ঘটনায় ১৯৯৫ সালে বিএনপি বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডের বিধান করেছিল। সেটা কি অপরাধ ঠেকিয়েছিল? ওই আইন পাঁচ বছর টিকেছিল। ২০১৫ সালে শুকুর আলীর মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেছিলেন, বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ড অসাংবিধানিক। কারণ তা বিচারকের স্বাধীনতাকে হরণ করে। আশা করি সংসদ এটা মনে রাখবে।

গবেষকেরা দেখেছেন, হত্যা নয়, ধর্ষণ সিরিয়াল অপরাধ। খুনের পর অপরাধীর চূড়ান্ত জিঘাংসা চরিতার্থ হয়। ধর্ষণে সেটা ঘটে না। তাই বিশ্বে সিরিয়াল সেক্স অফেন্ডারের সংখ্যা বেশি। একজন সিরিয়াল অপরাধীর মনস্তত্ত্ব হচ্ছে সে বিষয়টিকে ধর্ষণ মনে করে না। সে ভাবে যে কার্যত মেয়েটির সম্মতিতেই সে ধর্ষণ করেছে। মেয়েরা মুখে না বলে থাকে মাত্র। এ কারণে উন্নত বিশ্বে যৌন অপরাধীদের ডেটাবেইস থাকে। তারা সাজার পরে খালাস পেলেও পুলিশ এলাকাবাসীকে তার বিষয়ে সজাগ রাখে।

আজ রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর হয়ে আইনে পরিণত হবে এই সংশোধনী। ফলে আজ আমরা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন পাচ্ছি বলা যায়। আজ গেজেট হলে আজ থেকেই কার্যকর হবে সংশোধিত আইন। আইন অনুসারে আইন জারীর দিনক্ষন থেকেই ওই আইনে বিচার শুরু হয়। আইনটি যেহেতু নতুন নয় তাই এ আইনে বিচার করার জন্য প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে নতুন তেমন কোন উৎসাহ বা আকুতি নেই। কারণ নারী নির্যাতন দমন আইনে আগে থেকেই মৃত্যুদন্ড ছিল, এখনো আছে।

এদিকে চলমান আন্দোলনের চাপে পড়ে সরকার আইনের এই সংশোধন করেনি, প্রয়োজনের তাগিদে করেছেন, এমন কথা বলেছেন দায়িত্বশীল মন্ত্রী। আর আন্দোলনকারীরা তাদের বিজয় হয়েছে বলে উল্লাস করছেন। তবে জয় বিজয় না পরাজয় সেটা নির্ভর করবে আইনটি কি ভাবে কোন প্রক্রিয়ায় কতটুকু সততার সাথে কার্যকর করা যাবে সেটার উপর। আইনের যথাযথ প্রয়োগ, যথাসময়ে নির্ভুল তদন্ত ও বিচার কাজ সঠিক সময়ে শেষে হলে সুফল পাওয়া যাবে এমনটি আশা মানুষের।

একজন সিনিয়র সাংবাদিক লিখেছেন, মন্ত্রিসভা যে সংশোধন আনছে, তা আনা ছাড়া তাদের পক্ষে দ্রুত সম্ভবত আর কিছুই করে দেখানো সম্ভব নয়। কিংবা করার সক্ষমতা নেই। এরপরও যখন অবস্থা অপরিবর্তিত থাকবে, তখন তারা কী বলবে? তবে বড় প্রশ্ন, আমরা নারীর নিরাপত্তার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছি কি না, পারব কি না, পারতে চাই কি না? যেসব ক্ষেত্রে ‘মৃত্যুদণ্ড’ রয়েছে, সেই সব অপরাধ হচ্ছে কেন? কেউ কি যুক্তি দিয়ে বলবেন, মৃত্যুদণ্ড নেই বলেই ধর্ষণ বেড়ে গেছে? বিষাক্ত পদার্থ দ্বারা কোনো শিশু বা নারীর মৃত্যু ঘটলে মৃত্যুদণ্ড, দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি নষ্ট বা মুখমণ্ডল, স্তন বা যৌনাঙ্গ বিকৃত বা নষ্ট করা হলে মৃত্যুদণ্ড। পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য, মুক্তিপণ বা পাচার করলে মৃত্যুদণ্ড। ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ বা ওই ধর্ষণ–পরবর্তী অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে অভিযুক্ত প্রত্যেকের মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড। এটা প্রমাণিত যে এই মৃত্যুদণ্ডগুলো অপরাধ কমাতে পারেনি। দলবদ্ধ ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় জড়িত প্রত্যেকের মৃত্যুদণ্ড আমরা স্মরণ করতে পারি না। ধর্ষণের দায়ে ‘মৃত্যুদণ্ড’ শব্দটি আইনে নেই। এটা লিখলেই ষোলো কলা পূর্ণতা পাবে?

সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, সংশোধিত আইন শাস্তি হলে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার ১ শতাংশের নীচে নেমে আসবে। আর বিচার শেষ হতে ১২ বছর লাগবে। এতে শাস্তির দৃষ্টান্তমূল্য ভীষনভাবে হ্রাস পাবে।

আমরা চাই, আইনের যথাযথ ও কার্যকর প্রয়োগ। যথা সময়ে সততার সাথে মামলা গ্রহন ও তদন্ত করে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হউক। একই সঙ্গে আইনের কঠোরতা দেখে কেউ যেন অপরাধ করতে সাহস না পায় এবং কেউ যেন মিথ্যা মামলা করতেও ভয় করেন, সে কাজটির অপেক্ষায় জাতি। আমরা আশা করি, যেই লাউ সেই কদু যেন না হয়। লাউ কদু যেন এক না হয়। দুটি যেন ভিন্ন হয়। তাহলে আর কেউ বলতে পারবেন না, যেই লাউ সেই কদু।

রিপন আনসারী

প্রধান সম্পাদক

গ্রামবাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম

গ্রামবাংলানিউজবিডিটোয়েন্টিফোরডটকম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *