মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক কূটনীতি চাঙ্গা করে তুলছে। এজন্য ভার্চুয়ালি তারা প্রথমবারের মতো একটা উচ্চ পর্যায়ের সংলাপ করেছে । ঢাকার সঙ্গে একটি ওপেন স্কাই বা উন্মুক্ত আকাশ চুক্তি করেছে । এটা হল ওয়াশিংটনের ব্লু প্রিন্টের অংশ । এর লক্ষ্য হচ্ছে, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনা উপস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ করা ।
যুক্তরাষ্ট্রে যদিও এখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্যাম্পেইন চলছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের সেদিকে নজর দেয়ার কোনো অবকাশ নেই । কারণ তারা দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে রুখে দিতে চাইছে । তাদের ঢাল হচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক বা এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় মার্কিন রণকৌশল।
এখন এই অঞ্চলকে দেখা হচ্ছে মার্কিন বিদেশনীতির খুঁটি হিসেবে । সুতরাং হোয়াইট হাউসে এখন কে আছেন সেটা দেখার কোন সময় কারো নেই ।
গত ৩০শে সেপ্টেম্বর এই সংলাপে অংশ নিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জ্বালানি এবং পরিবেশ বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি কিথ ক্রাচ। তিনি সম্মত হয়েছেন যে, তিনি বাংলাদেশে জ্বালানি, তথ্যপ্রযুক্তি ,ফার্মাসিউটিক্যালস এবং কৃষি খাতে বিনিয়োগের জন্য আমেরিকান কোম্পানিগুলোর প্রতি আহ্বান জানাবেন।
এই ভার্চুয়াল ডায়লগ এমন একটা সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে যখন একই দিনে ঢাকায় দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে আকাশ যান চলাচল চুক্তি বা এয়ারসার্ভিস এগ্রিমেন্ট। এই এগ্রিমেন্টের আওতায় গত বুধবার থেকে বাংলাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট চলাচল শুরুর চুক্তিটি কার্যকারিতা পেল। এই ফ্লাইট চলাচল শুরু হচ্ছে ওয়াশিংটনের ওপেন স্পেস পলিসির আওতায়।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাক্ষরিত আকাশ চুক্তি দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অংশীদারিত্বকে আরো শক্তিশালী করে তুলবে । জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কে উন্নতি ঘটাবে । এয়ারলাইনস, ট্রাভেল কম্পানি এবং বিমান যাত্রীদের মধ্যে একটা নতুন সুবিধার সুযোগ সৃষ্টি করবে।
উল্লেখ্য, গত ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর. মিলার এবং বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোঃ মজিবুল হকের মধ্যে ওই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুমান করা হয় যে ৫ লাখ বাংলাদেশি রয়েছেন । এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশের পতাকাবাহী বিমান আবার ঢাকা এবং নিউইয়র্ক রুটির মধ্যে চলাচল শুরু করবে। এই রুটটি ২০০৬ সালে বাণিজ্যিক অসুবিধার কারণ দেখিয়ে স্থগিত করা হয়েছিল।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প এবং বিনিয়োগ সংক্রান্ত উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান সম্প্রতি নিকি এশিয়াকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘ আমরা যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পুনরায় মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হলাম, তার মূলে রয়েছে আমাদের অর্থনীতির আয়তন।’
‘ বাংলাদেশ একটি বৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হতে চলেছে।’ মন্তব্য করেছেন রহমান।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবি চলতি বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার দেখিয়েছে ৫.২ শতাংশ। যখন অধিকাংশ এশীয় দেশের অর্থনীতিতে যাচ্ছে মন্দা।
গত বছরগুলোতে বাংলাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতর হয়েছে। অর্থনৈতিক এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ছিল এর চালিকাশক্তি । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যালায়েন্সের দিক থেকে ‘এমার্জিং পার্টনার’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এবং উভয় দেশ ‘আমেরিকান মিলিটারি গিয়ার’ বিক্রির বিষয়ে গত বছর আলোচনা শুরু করেছে।
অবশ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, ওয়াশিংটন- ঢাকার সম্পর্ককে অগ্রসরমান হিসেবে দেখতে হবে । তার কারণ ঢাকার সঙ্গে বেইজিংয়ের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক । বাংলাদেশ সম্প্রতি চীনের হাতে আড়াইশো মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যায়সাপেক্ষ এয়ারপোর্ট টার্মিনাল নির্মাণের একটি কাজ দিয়েছে । যা কিনা, চীনে বাংলাদেশি পণ্যের প্রবেশাধিকারে ৯৭ ভাগ শুল্ক কমানোর প্রতিক্রিয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর দেলোয়ার হোসেন নিকিকে বলেছেন, বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়ার শক্তি দেখিয়েছে । ওই অধ্যাপকের কথায়, এই পররাষ্ট্র নীতির আওতায় চীন হয়তো অস্বস্তি অনুভব করতে পারে যে, বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উষ্ণতা ছড়িয়ে চলছে। তেমনি ওয়াশিংটন হয়তো ক্ষুণ্ন হবে ঢাকা-বেইজিংয়ের রোমান্স দেখে।
কিন্তু প্রফেসর দেলোয়ার হোসেন যেমনটা বলেছেন, এসব সত্ত্বেও কোনো পক্ষই বাংলাদেশকে ছাড়তে চাইছে না। তার কারণ অর্থনীতিতেই নিহিত। মালদ্বীপ এবং শ্রীলঙ্কার মতো ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশ একা যা করতে পারে, সেটা করে দেখানো সম্ভব নয় । আর সেটা হলো, বাংলাদেশ একাই যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনকে দেখাতে পারে যে, তারা তাদের উভয়ের পণ্য বাংলাদেশ ভালই আমদানি করার হিম্মত রাখে।
যেটা মালদ্বীপ বা শ্রীলংকার পারে না। অন্যদিকে ভারত এবং পাকিস্তান ইতিমধ্যেই যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সঙ্গে মিত্রতা তৈরি করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলো বাংলাদেশি পণ্যের বৃহত্তম রপ্তানি বাজার । এর পরিমাণ ৭শ কোটি মার্কিন ডলার । আর বাণিজ্য উদ্বত্ত ঢাকার অনুকূলে রয়েছে । বিপরীতক্রমে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি গত বছরে ছিল বারোশো কোটি ডলার। বাংলাদেশের আমদানির বৃহত্তম উৎস। উপরন্তু তার অস্ত্র আমদানীর শতকরা ৭০ ভাগের বেশি সরবরাহ করে থাকে চীন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সাম্পতিক কনসালটেশন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সালমান এফ রহমান । তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এভিয়েশন চুক্তি করার জন্য চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ‘চমৎকার’ সম্পর্কে কোন অবনতি ঘটার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন । রহমান বলেছেন, ‘আমাদের বাণিজ্য পরিবেশ উন্নত হচ্ছে। আমরা অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করছি।’
ঢাকা এবং বেইজিংয়ের মধ্যকার অর্থনৈতিক সহযোগিতা গভীরতর হচ্ছে । ২০১৬ সালে যখন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ সফর করেছিলেন, তিনি তখন সাতাশটি প্রকল্পের বিপরীতে ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ কমিটমেন্ট করেছিলেন । আর সেটা তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর আওতায়।
ঢাকা ভিত্তিক থিংকট্যাংক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিকিকে বলেছেন, ‘ আমাদেরকে একটা সরু রশির উপর দিয়ে হাঁটতে হবে । বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের জন্য আমাদেরকে কূটনৈতিকভাবে কার্ড খেলতে হবে। ‘
তিনি বলেছেন, যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বাংলাদেশকে অবশ্যই চীনের দিকে একটু ঝুঁকে থাকতে হবে । কারণ চীনের কাছ থেকে তাকে অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন করে নিতে হবে । আর সেই তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে অর্থনৈতিক শক্তি রয়েছে, সেটা চীনের তুলনায় পর্যাপ্ত হওয়া থেকে অনেক দূরে।
মনসুর বলেছেন, আগামী নভেম্বরের নির্বাচনে যদি ডেমোক্রেটিক চ্যালেঞ্জার জো বাইডেন জয়ী হন, তাহলেও তা বিশ্ব রাজনীতিতে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবে না। এমনকি ওয়াশিংটনের ইন্দো-প্যাসিফিক নীতিতে তা কোনো পরিবর্তন আনবে না । ভারত তাদের আঞ্চলিক পার্টনারই থেকে যাবে । ট্রাম্পের মতোই, বাইডেনের লক্ষ্য হবে চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা । চীন এই মুহূর্তে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি ।
কিন্তু মনসুর যিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল ইউনিটের প্রধান ছিলেন,তিনি একটি প্রশ্ন তুলেছেন । ‘ বাংলাদেশের কেন ওই খেলায় যাওয়া উচিত?’
তিনি একটি নিরপেক্ষ বিদেশ নীতি অনুসরণে গুরুত্ব আরোপ করেন কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি এই মন্তব্য জুড়ে দিয়েছেন যে: ‘এমন সময় খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন প্রথম অবস্থানকারীকে টেক্কা দিয়ে দ্বিতীয় স্থানধারী উপরে উঠে যাবে।’
এশিয়া.নিকি. কমে লেখাটি ৬ অক্টোবর ছাপা হয়েছে।