আমার ছোট বেলার বেড়ে উঠাটা অন্য বাচ্চাদের থেকে ভিন্য ছিল কেননা আমি আমার বাবা হারাই আমার বয়স যখন মাত্র ৫-৬ I ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পরপরই ৩ নভেম্বর জেল খানায় আমার পিতা সহ জাতীয় চার নেতাকে (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান) হত্যা করা হয় I এক অর্থে আমার মা কেও হারাই কারণ তিনি সে সময় এই সমস্ত হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে এবং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনার লক্ষে নিজেকে বিলিয়ে দেন I
এই প্রেক্ষাপটে আমার বেড়ে উঠা I ছোট বেলা থেকেই আমি মিষ্টির পোকা ছিলাম- চকলেট, রসমালাই, চম চম, হালুয়া, সেমাই, আইস ক্রিম- এগুলোই ছিল আমার প্রিয় I এই ধরণের খাদ্যাভাসের কারণে দুই ধরণের সমস্যা দেখা দেয় ১. দাঁতের সমস্যা আর ২. শারীরিক ও মানসিক I দাঁতের সমস্যা হলেও তা ডেন্টিস্ট এর চিকিৎসায় সমাধান হয় কিন্তু দ্বিতীয় সমস্যা ছিল আরো অনেক জটিল I ৮-৯ বছর বয়েসে আমি অনেক ভারী বা মোটা হয়ে যাই (যেটাকে অনেক অভিভাবকেরা ভুল ভাবে হেলথি বলে আখ্যায়িত করেন) আমাকে নিয়ে অনেকেই হাসা হাসি করতো এবং এই ধরণের আচরণের কারণে আমি মানসিক ভাবে অনেক কষ্ট পেতাম এবং আমার আত্মবিশ্বাস একদমই ছিল না বললেই চলে I আমি ফুটবল খুব পছন্দ করতাম কিন্তু আমার স্কুল টিমে স্থান হতো না কারণ কোচ আমাকে বলতেন যে আমি বেশি ভারী তাই আমার ঠিকমতো দৌড়াতে সমস্যা হবে I এই কষ্ট যন্ত্রনা নিয়ে আমার ছোটবেলার সেই দিনগুলো- কিন্তু সমাধান কি ? আমার ভিতরে প্রচন্ড জিদ- আমি শুধু জানি কোনো না কোনো ভাবে পথ বের করতেই হবে যেকোনো মূল্যে I তখন ইন্টারনেট আবিষ্কার হয় নাই- মানে নাই কোনো ইউটিঊব, নাই সোশ্যাল মিডিয়া I কিছু জানার একমাত্র উপায় হচ্ছে টিভির ১টা চ্যানেল বি টি ভি I সেখান থেকে খেলোয়াড়দের উপর করা ট্রেনিং ডকুমেন্টারী দেখতাম-আর শেখার চেষ্টা করতাম I আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল যেদিন সেসময়কার দুর্দান্ত বা হাতি পেস বলার দিপু চৌধুরী আমাদের বাসায় আসেন I তিনি আমাকে বাসার ছাদে জগিং করা সেখান I শুরু হলো আমার ফিটনেস যাত্রা- আমার তখন ১১ বছর বয়স I জগিংয়ের সাথে আমাদের তিনতালা বাসার সিঁড়ি উঠা নামা, ফ্যানের হুকে দুইটা রিং ঝুলিয়ে, আবাহনী মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট, বাস্কেটবল, হকি খেলার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে পেলাম I
তারপর আমার জীবনে নতুন করে প্রভাব ফেললো সিলভেস্টার স্ট্যালোন তার “Rocky” এবং “Rambo” আর আর্নল্ড স্বরজজেনেগের তার “Commando” “Terminator” আর “Conan the Barbarian” মুভির মাধ্যমে I সেই সময় আমার বয়স ১৪-১৫ I আমার এই আগ্রহ দেখে আমাদের বাসার একজন বিদেশী ভাড়াটিয়া আমাকে তার একটা পুরোনো ১০ কে জি ওজনের বারবেল উপহার দিলেন I আমি সেই বারবেল দিয়ে কিছু বেয়াম করা শিখলাম আমার ইরানি দুলাভাইয়ের কাছ থেকে যিনি ইরানে ক্লাসিক রেসলিং চ্যাম্পিয়ন ছিলেন এবং বাংলাদেশ ফেডারেশন এ হেড কোচের দায়িত্বও পালন করেছিলিন I
পরবর্তীতে আমেরিকায় আমার ছাত্র জীবনে আমার টিউশন ফী, থাকা খাওয়ার খরচ দিতে দুই টা পার্ট টাইম জব করতে হয় I রাতে গড়ে ঘুমাতাম ৩-৪ ঘন্টা কিন্তু আমার ফিটনেস এর প্রতি আকর্ষণের কোনো ঘাড়তি ঘটে নাই I আমার পছেন্দের জিম এ গিয়ে আমি বাস্তবতার সম্মুখীন হই- মেম্বারশিপ আমার সামর্থের বাইরে I হতাশ না হয়ে সমাধান খুঁজি I কিছু টাকা জমিয়ে সেকেন্ড হ্যান্ড কিছু যন্ত্রপাতি আর ওজন কিনে রাতে আমার নাইট শিফট জব এ হোমওয়ার্ক এর পাশাপাশি বেয়াম চালাই I এমনও দিন গিয়েছে যখন শুধু সিদ্ধ ডিম্, পাও রুটি আর কলা খেতে হয়েছে সকাল, দুপুর আর রাতে I কিন্তু এই অবস্থাতেও আমি আমার ফিটনেস জার্নি ধরে রেখেছি- অজুহাত বানিয়ে নিজের সাথে প্রতারণা করি নাই I পরবর্তীতে, কয়েক বছর পর যখন সামর্থ হয়েছে তখন আমার সেই পছন্দের জিম এ ভর্তি হই I ইচ্ছা থাকলে আর চেষ্টা করলে সবই সম্ভব- অজুহাত হচ্ছে দুর্বলদের জন্য I
এই ফিটনেস জীবনধারার কারণে আল্লাহর রহমতে আমি আমার জীবনে সার্বিক ভাবে অনেক সুফল পেয়েছি- শারীরিক এবং মানসিক I ইট ইজ নেভার টু লেইট টু স্টার্ট…….
সূত্র— সোহেল তাজের পেজ