সিলেট:সিলেটে সব আলোচনা এখন দুই আওয়ামী লীগ নেতাকে ঘিরে। সবার মুখে মুখে তাদের নাম। আলোচনা-সমালোচনা। কী হবে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সে প্রশ্নও সর্বত্র। এই দু’ নেতা হলেন আজাদুর রহমান আজাদ ও এডভোকেট রণজিৎ সরকার। এমন এক সময় এই ঘটনা ঘটলো যখন এই দুই নেতার নাম জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটির ‘গুরুত্বপূর্ণ’ পদে প্রস্তাব করা হয়েছিল। এমসির ছাত্রাবাসের ঘটনার পর তারা দু’জনই আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের নজরে এসেছেন। এ কারণে সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের পদবিধারী চার নেতাকে ঢাকায় তলব করে তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন দলের সিনিয়র নেতারা।
ঢাকায় অবস্থান করা আওয়ামী লীগের নেতারা জানিয়েছেন, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটিতে এডভোকেট রণজিৎ সরকারের নাম সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটিতে আজাদুর রহমান আজাদের নাম সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছিল। এমসি কলেজের ঘটনার পর কমিটিতে তাদের নাম থাকবে কিনা- সেই ভাগ্য নির্ধারণ করবে কেন্দ্র। সিলেটের টিলাগড়ে সব সময় শক্তিশালী ছাত্রলীগ। বলা হয়- সিলেট ছাত্রলীগের হেডকোয়ার্টার টিলাগড়। এমসি, সরকারি কলেজ কেন্দ্রিক ছাত্রলীগের রাজনীতিই নিয়ন্ত্রণ করে টিলাগড়। আর টিলাগড়ে ছাত্রলীগের এই অবস্থান সুসংহতের নেপথ্যে কারিগর হচ্ছেন আজাদুর রহমান আজাদ ও রণজিৎ সরকার। এক সময় দু’জন একসঙ্গেই টিলাগড়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। যুবদলেও ছিলেন একত্রে। কিন্তু দল ভারী হওয়ার কারণে তাদের সেই একসঙ্গে চলার স্থায়িত্ব বেশিদিন হয়নি। গত এক দশক ধরেই টিলাগড়ে একে অপরের বিপরীত মেরুতে অবস্থান নেন তারা। বিভক্তির পর থেকে তাদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। এই দ্বন্দ্বের জের ধরে টিলাগড়ে গত ৮ বছরে ৮ ছাত্রলীগ কর্মী খুন হয়েছেন। এমসি কলেজ ও টিলাগড়ে অসংখ্যবার হয়েছে সংঘর্ষ, অস্ত্রের মহড়া, গুলিবিনিময়ের ঘটনা। এসব ঘটনার কারণে সিলেট ছাত্রলীগ হয়েছে বিতর্কিত। সিলেট ছাত্রলীগের দুর্নামের ‘ট্যাগ’ স্থাপন করেছে টিলাগড় ছাত্রলীগই। আজাদুর রহমান আজাদ সিলেটের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের চার বারের সিটি কাউন্সিলর। এর আগে তার ভাই ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। আরেক ভাই ছিলেন পৌর কমিশনার। ফলে টিলাগড়ে পারিবারিকভাবে শক্তিশালী অবস্থান আজাদুর রহমান আজাদের। এলাকায় তার রয়েছে ‘একচেটিয়া’ আধিপত্য। এ কারণে ভোটের রাজনীতিতে আজাদ জয়লাভ করেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আজাদুর রহমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, টিলাগড়ে আজাদুর রহমান আজাদ তার বলয়ের বিতর্কিত রাজনীতির লাগাম টেনে ধরেছেন কয়েক বছর আগেই। এরপর বলয় বড় হওয়ার কারণে নানা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। আজাদ এসব ঘটনাকে সামাজিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করছেন। মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সুসংহত অবস্থান ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনের টার্গেটে তিনি বিতর্কিত কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। কিন্তু নানা সময় তার গ্রুপের কর্মীদের জমি দখল, ছিনতাইসহ নানা কর্মকাণ্ডে তিনি বিতর্কিত হচ্ছেন। টিলাগড়ে ঘটনা ঘটলেই দোষ পড়ে তার ওপর। তবে আজাদুর রহমান আজাদ জানিয়েছেন- ‘টিলাগড়কে বিতর্কমুক্ত রাখতে তিনি কাজ করছেন। এমসি কলেজে গণধর্ষণের ঘটনায় তিনি বুধবার রাতে এলাকার মানুষকে নিয়ে বৈঠক করেছেন। টিলাগড়কে জঞ্জালমুক্ত করতে তিনি এলাকার মানুষের সহযোগিতা কামনা করেন।’ তিনি জানিয়েছেন- ‘এমসি কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার। অনেকেই বসবাস করে টিলাগড় এলাকায়। তাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে টিলাগড়ের মানুষও ভুক্তভোগী হয়। এর দায় পড়ে আমার কিংবা এলাকার মানুষের ওপর।’ টিলাগড়ে ছাত্রলীগের আরেক অংশের নিয়ন্ত্রক এডভোকেট রণজিৎ সরকার। এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতরা সবাই তার গ্রুপেরই সদস্য। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, টিলাগড় থেকে বালুচর এলাকা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করেন রণজিৎ গ্রুপের ছাত্রলীগের কর্মীরা। তারা এমসির ক্যাম্পাস এবং ছাত্রাবাসও নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। তাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডই বেশি। এমসি ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের ঘটনার পর দেখা গেছে, ছাত্রাবাসকে তারা অপরাধের হেডকোয়ার্টার হিসেবে গড়ে তুলেছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন- এমসির ছাত্রাবাসের ঘটনায় মাত্র একজন ছাত্র ছিল। অন্যরা ছিল বহিরাগত। রণজিৎ গ্রুপের বহিরাগত কর্মীরাই হোস্টেলে অপকর্ম চালাতো। তবে রণজিৎ সরকার জানিয়েছেন, টিলাগড় বাড়ি হওয়া তার জন্য কাল হলো। তাকে এই ঘটনায় বিতর্কিত করে তোলা হয়েছে। নিজের ফেসবুক আইডিতে ঘটনার পরদিন রণজিৎ সরকার স্ট্যাটাস দিয়ে ঘটনাকারীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছিলেন।
টিলাগড় ছাত্রলীগ এখন বিতর্কের কেন্দ্রে। এলাকায় তো নিজেদের আধিপত্য রয়েছে। এরপর সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, জাফলং, বিছনাকান্দি পাথর কোয়ারিতে আধিপত্য বিস্তারে নেয়া হয় তাদের। কোথাও জমি দখল কিংবা বিরোধপূর্ণ ঘটনায় শক্তি প্রদর্শনেও তাদের ব্যবহার করা হয়। তাদের কর্মকাণ্ডের কারণে সিলেট আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ প্রায়ই বিতর্কিত হয়। এদিকে এমসির ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের ঘটনার পর গতকাল কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ঢাকায় তলব করেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট লুৎফুর রহমান, মহানগর সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ, জেলার সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান, মহানগর সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেনকে। গতকাল সকালেই লুৎফুর রহমান ছাড়া বাকি তিনজন ঢাকায় পৌঁছেন। ঢাকায় অবস্থান করা আওয়ামী লীগের এক নেতা জানিয়েছেন, এমসি কলেজের ঘটনার প্রেক্ষিতেই তাদের ঢাকায় তলব করা হয়েছে। বিকালে তারা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠক থেকে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড এড়াতে সিলেটের নেতাদের বেশকিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বৈঠকে অংশ নেয়া এক নেতা জানান, কেন্দ্রীয় নেতারা আজাদ-রণজিৎ দু’জনের ওপরই ক্ষুব্ধ। কারণ এমসির ছাত্রাবাসের ওই ঘটনা থেকে তারাও দায় এড়াতে পারেন না। ফলে আসন্ন কমিটিতে তাদের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে সেটি কেবল কেন্দ্রীয় নেতারাই বলতে পারবেন।