ঢাকা: সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৯শে মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিএনপি’র ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পর কাউন্সিল করার কথা। কিন্তু দুই বছর আগে এ কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও এখনো দলের কাউন্সিল করার উদ্যোগ নেয়নি বিএনপি। এ বছরই বিএনপি’র সপ্তম কাউন্সিল হচ্ছে- এমন খবর সম্প্রতি চাউর হয়। কিন্তু দলীয় নীতি-নির্ধারক মহল সূত্র জানিয়েছেন, শিগগিরই হচ্ছে না দলটির কাউন্সিল। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দি থাকাকালে দলটির সিনিয়র নেতারা বলেছিলেন, দলীয় প্রধান কারামুক্ত হলে কাউন্সিল নিয়ে ভাববেন। শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পেয়েছেন বেগম জিয়া। প্রথম দফায় মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস থাকলেও পরের দফায় ফের ছয় পৃষ্ঠা ১০ কলাম ১
মাস বাড়ানো হয়েছে।
তবে তিনি কারাগারের বাইরে থাকলেও কোনো রাজনীতি করতে পারবেন না। এদিকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রয়েছেন দেশের বাইরে। এছাড়া বিএনপি’র ৮১টি সাংগঠনিক জেলায় কমিটির মেয়াদ নেই। মূলত এসব কারণেই কাউন্সিল আয়োজনে প্রধান বাধা হিসেবে দেখছে বিএনপি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপট ও বয়সের বিবেচনায় গতিশীল ভূমিকা পালন করতে পারছেন না বিএনপি স্থায়ী কমিটির নেতারা। এছাড়া সদস্যদের মধ্যে দুই/একজন ছাড়া প্রায় সকলেই বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ফলে তাদের পক্ষে মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ নেই। তারা কেবল ঘরে বসে ‘উপদেষ্টা পদ’-এ থেকে দলকে পরামর্শ দিতে পারেন। মাঠের রাজনীতি তরুণদের হাতে তুলে দিতে হবে।
কাউন্সিলের বিষয়ে বিএনপি’র বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা হয় মানবজমিন’-এর। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দলের সিনিয়র নেতারা কাউন্সিল নিয়ে কিছুটা অনীহা দেখালেও জুনিয়র নেতারা কাউন্সিল করার বিষয়ে আগ্রাহী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের এক যুগ্ম মহাসচিব বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় কমিটি মেয়াদ উত্তীর্ণ। দলের অনেক নেতাই বয়সের কারণে দলে তেমন সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারছেন না। দেশের এই পরিস্থিতিতে দলকে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় রাখতে হলে যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। তাই আমি মনে করি এখন দলের তরুণ নেতাদের দায়িত্ব দিতে হবে। তাই শিগগিরই দলের কাউন্সিল করা উচিত।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মানবজমিনকে বলেন, আপাতত আমরা কাউন্সিল নিয়ে ভাবছি না। করোনা মহামারির কারণে আমাদের দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল। এখন আবার দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়েছে। এ সবতো দলের কাউন্সিলেরই অংশ।
কাউন্সিল না হওয়ায় শিগগিরই পূরণ হচ্ছে না বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির শূন্য পদগুলোও। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ, ভাইস-চেয়ারম্যান এবং নির্বাহী কমিটির ফাঁকা পদ পূরণ নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের পর ঘোষিত ১৯ সদস্যের নীতি-নির্ধারণী ফোরামে ১৭জন সদস্যের নাম প্রকাশ করা হয়। ফাঁকা রাখা হয় ১৭ ও ১৮ নম্বর পদ। সেই সময় আলোচনায় আসে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার দুই পুত্রবধূ ডা. জোবায়দা রহমান ও শর্মিলী রহমান সিঁথির নাম। এর আগে থেকেই আলোচনায় থাকা বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন, আবদুল্লাহ আল নোমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, আবদুল আউয়াল মিন্টুর মতো প্রবীণ রাজনীতিবিদেরও জায়গা হয়নি স্থায়ী কমিটিতে। এরপর ব্রিগেডিয়ার (অব.) আ স ম হান্নান শাহ্, এমকে আনোয়ার, তরিকুল ইসলাম মারা যান। এছাড়া রাজনীতি থেকে অনেকটা নীরবে অবসরে চলে যান লে.জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান। ফলে দলের স্থায়ী কমিটিতে ৬টি শূন্য পদ তৈরি হয়। এর মধ্যে গেল বছরের জুনে দলের স্থায়ী কমিটিতে বেগম সেলিমা রহমান এবং ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে অন্তর্ভুক্ত করে শূন্য পদ পূরণ করা হয়। এখনও চারটি পদ ফাঁকা রয়েছে। এরমধ্যে নতুন করে আলোচনায় আছেন, বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, বরকত উল্লাহ বুলু, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মেয়াজ্জেম হোসেন আলাল প্রমুখ।
দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা-ভাইস চেয়ারম্যান এবং নির্বাহী কমিটিসহ প্রায় ৩০টি পদ শূন্য রয়েছে। এরমধ্যে বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকাসহ বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। কেউ কেউ আবার দল ত্যাগ করেছেন। দলের ৭৩ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটির ফজলুর রহমান পটল, বেগম সারোয়ারী রহমান, হারুন অর রশিদ খান মুন্নু, আখতার হামিদ সিদ্দিকী, জাফরুল হাসান, নূরুল হুদা, কবির মুরাদ, সঞ্জীব চৌধুরী, ওয়াহিদুল ইসলাম ও এমএ হক মারা যান। এছাড়া বিএনপি’র আইন বিষয়ক সম্পাদক এডভোকেট সানা উল্লাহ মিয়া, গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক আবু সাঈদ খোকন, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক বদরুজ্জামান খসরু, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ মোজাফ্ফর হোসেন, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল আউয়াল খান মারা গেছেন। বিএনপি’র নির্বাহী কমিটির সদস্যদের মধ্যে শফিউল বারী বাবু, আহসান উল্লাহ হাসানসহ বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। বিএনপি ছাত্র ও সহ-ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক পদ দু’টি ফাঁকা রয়েছে। বিএনপি’র যুব বিষয়ক সম্পাদকের পদটিও ফাঁকা। এছাড়া বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছেন, দলের কোষাধ্যক্ষ মিজানুর রহমান সিনহা, সহ-অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক শাহাবুদ্দিন আহমেদ, সহ-সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক মনির খান, বিএনপি নির্বাহী কমিটির সদস্য আলী আসগর লবী ও ইসমাইল হোসেন বেঙ্গল (সম্প্রতি তিনি মারা যান)। এছাড়া কয়েকজন পদায়ন হওয়াতে কয়েকটি পদ খালি হয়।
সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, কাউন্সিল দলের সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার একটা অংশ, এটা গঠনতন্ত্রেও নিয়ম আছে। গঠনতন্ত্র তো দলের জন্য, জীবনের জন্যই। সে কারণে আমাদের কাউন্সিলটা যে সময় হওয়ার কথা সে সময়ে হয়নি। ভবিষ্যতে হবে। বিশ্ব ও বাংলাদেশের পরিস্থিতি কখন অনুকূলে আসবে, কাউন্সিল করার সুযোগ সৃষ্টি হবে সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে। বিএনপি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল। এর কাউন্সিল ভার্চ্যুয়াল বা অনলাইনে হয় না। কাউন্সিল মানে হলো ব্যাপক আয়োজন। প্রায় চার হাজারের মতো কাউন্সিলর আছেন। কাউন্সিলে লাখ লাখ লোক সমবেত হয় এসব বিবেচনায় রাখতে হবে।