সিলেট: বিতর্কের আরেক নাম টিলাগড় ছাত্রলীগ। বহু বিতর্কিত ঘটনার জন্মদাতা এই টিলাগড় ছাত্রলীগ। তাদের একের পর এক বিতর্কিত ঘটনার জন্য দুই বছরের অধিক সময় ধরে কমিটি নেই সিলেট জেলা ছাত্রলীগে। বিলুপ্ত করে রাখা হয়েছে ছাত্রলীগের কমিটি। এরপরও লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না টিলাগড় ছাত্রলীগের। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, জমি দখল, ধর্ষণ- এমন কোনো ঘটনা নেই যে টিলাগড় ছাত্রলীগ করছে না। এমসি কলেজ সরকারি কলেজের পাশাপাশি সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের নিয়ন্ত্রক এই ছাত্রলীগ। তাদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে তটস্থ সবাই।
ভয়ে কেউ মুখ খোলেন না। যারাই প্রতিবাদী হয়েছে তাদের উপর হয়েছে হামলা-মামলা। তুচ্ছ ঘটনায় টিলাগড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি বহু পুরনো। এই টিলাগড় ছাত্রলীগের হাতেই ভস্মিভূত হয়েছিল এমসি কলেজের শতবর্ষী ছাত্রাবাস। ২০১২ সালের ৮ই জুলাইয়ের ঘটনা। হোস্টেলের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আগুন দেয় ছাত্রলীগকর্মীরা। এই ঘটনাও ছিল দেশজুড়ে আলোচিত। ন্যক্কারজনক এই ঘটনার পরও ছাত্রলীগের টিলাগড় গ্রুপ নিবৃত হয়নি। এরপর গত ৮ বছরে এমসি কলেজে একাধিকবার মুখোমুখি হয়েছে ছাত্রলীগ। নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারে হয়েছে গুলির লড়াইও। প্রকাশ্য অস্ত্র প্রদর্শন করা হলেও টিলাগড়ে ‘চোখ’ নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। টিলাগড়ের গা ঘেঁষেই এমসি কলেজ। ১২৮ বছরের পুরাতন কলেজ। এই কলেজ দেশের অন্যতমও। যুগে যুগে অনেক মন্ত্রী, এমপি, সচিব ও কৃতি সন্তানদের গড়ে তুলেছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সবোর্চ্চ এই বিদ্যাপিঠ। এমসি কলেজকে কেন্দ্র করেই সব গুরুত্ব টিলাগড়ের। পরে কলেজ সরকারি হয়। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজও টিলাগড় এলাকায়। এক সময় সরাসরি ছাত্র রাজনীতির কারণে টিলাগড়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল আজাদুর রহমান আজাদ ও রঞ্জিত সরকারের হাতে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ হয়ে আজাদুর রহমান আজাদ এখন মহানগর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। টিলাগড় এলাকার কাউন্সিলরও তিনি। ২০১৮ সালের সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গুরুত্বপূর্ণ এ ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। রঞ্জিত সরকারও আজাদের দীর্ঘদিনের সহকর্মী। একত্রেই তারা এক সময় টিলাগড় নিয়ন্ত্রণ করেছেন। এ কারণে টিলাগড় ছাত্রলীগের সঙ্গে ‘আজাদ-রঞ্জিত’ নামটি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। বেশ কয়েক বছর ধরে তারা বিভক্ত। নিজেদের মধ্যে বনিবনা না হওয়ার কারণে তারা আলাদা হয়ে গেছেন। ফলে টিলাগড়ে এখন আজাদ ও রঞ্জিত দুই গ্রুপেরই অবস্থান। এর মধ্যে ছোট ছোট কিছু উপ গ্রুপেরও সৃষ্টি হয়েছে। এসব গ্রুপের মূল নিয়ন্ত্রক হচ্ছেন, সিনিয়র দুই নেতা।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন- টিলাগড়ের আধিপত্য নিয়ে আজাদ-রঞ্জিত গ্রুপের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। এর পাশাপাশি এমসি সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ছাত্রলীগের ওই গ্রুপের দ্বন্দ্ব। আছে টেন্ডার ভাগাভাগি, জমি দখল নিয়েও দ্বন্দ্ব। এসব দ্বন্দ্বের কারণে গত এক যুগে অন্তত ৫টির মতো খুনের ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন- শেল্টারদাতাদের কারণেই টিলাগড় ছাত্রলীগ কর্মীরা বেপরোয়া। এমসি কলেজের হোস্টেলে এক সময় ছাত্র শিবিরের আধিপত্য ছিল। শিবিরকে হটিয়ে ছাত্রলীগ দখলে নেয়। এরপর থেকে হোস্টেলের সবকিছুতেই ছাত্রলীগের আধিপত্য।
করোনাকালে হোস্টেল বন্ধ থাকার কথা থাকলেও ছাত্রলীগ কর্মীরা জোরপূর্বক দখলে রেখেছিল বিভিন্ন রুম। কিলিং জোন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় টিলাগড়কে। ২০০৩ সালের ৭ই জানুয়ারি থেকে গত ৬ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টিলাগড়কেন্দ্রিক রাজনীতির কোন্দল আর বিরোধে খুন হয়েছেন ৮ ছাত্রলীগ নেতা ও কর্মী। টিলাগড়ে সর্বশেষ ফেব্রুয়ারিতে সাদীপুরের দীপক দে’র ছেলে অভিষেক দে দ্বীপ খুন হয়। দ্বীপ ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। অভ্যন্তরীণ বিরোধে ২০১০ সালের ১২ই জুলাই এমসি কলেজের গণিত বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগকর্মী উদয়েন্দু সিংহ পলাশ খুন হন টিলাগড়ে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ফের খুনের ঘটনা ঘটে। ওই বছরের ১৪ই সেপ্টেম্বর টিলাগড়ে ছোট ভাইকে জিম্মি করে ‘সুরমা গ্রুপে’র ছাত্রলীগকর্মী জাকারিয়া মোহাম্মদ মাসুমকে শিবগঞ্জে ডেকে এনে খুন করা হয়। খুনের মামলার আসামি হন টিলাগড় কেন্দ্রিক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। ২০১৭ সালের ১৬ই অক্টোবর টিলাগড়ে খুন হন ছাত্রলীগকর্মী ওমর মিয়াদ। এ খুনের পর ১৮ই অক্টোবর সিলেট জেলা ছাত্রলীগের কমিটি বাতিল করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এখন অবধি আর নতুন কমিটি গঠন করা হয়নি। ২০১৮ সালের ৭ই জানুয়ারি টিলাগড়ে খুন হন ছাত্রলীগকর্মী তানিম খান।
আজাদের দাবি: গত কয়েকদিন ধরে এমসি কলেজ ক্যাম্পাস, কলেজের ছাত্রাবাস ও টিলাগড়কেন্দ্রিক ছাত্রলীগের বিভিন্ন অপকর্ম নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে। কিছু কিছু সংবাদে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আমার নামও জড়ানো হয়েছে। যা খুবই দুঃখজনক। প্রায় ২৬ বছর আগে আমি ছাত্রলীগের রাজনীতি শেষ করে যুবলীগ করে বর্তমানে আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়। আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের একজন সৈনিক, আমার নেত্রী শেখ হাসিনা এবং আমি তারই রাজনীতি করি। আমার কোনো গ্রুপ নেই। আমি গ্রুপিংয়ের রাজনীতিতে বিশ্বাসীও নই। এমসি কলেজ, ছাত্রাবাস ও টিলাগড়কেন্দ্রিক ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। স্কুলে পড়ালেখার সময় থেকে আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হই। এরপর জেলা ছাত্রলীগের দায়িত্ব পালন করে ১৯৯৬ সালে যুবলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হই। জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালেই ২০০৩ সালে আমি সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক নির্বাচিত হই। গত কমিটিতে আমি শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ছিলাম। আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে গত ১৭ বছর থেকে আমি রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছি। তাই গত ২৬ বছর থেকে আমি ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে দূরে। একজন জনপ্রতিনিধি (সিটি করপোরেশনের চারবারের কাউন্সিলর) হিসেবেও আমি দীর্ঘদিন ধরে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি। এমসি কলেজ সংলগ্ন টিলাগড়ে আমার স্থায়ী ও আদিনিবাস হওয়ায় ওই এলাকায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা কোনো অপকর্ম করলেই রাজনৈতিকভাবে আমাকে হেয় করতে মহলবিশেষ আমার নাম জড়ানোর চেষ্টা করেন। আমি কখনো কোনো অপরাধে মদত বা অপরাধীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেইনি। কোনো অপরাধীর পক্ষে থানা-পুলিশেও কোনোদিন তদবির করিনি। বরং অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকা নিতে সবসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করেছি। এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে যারা ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। এ ঘটনার পর কারা অপরাধীদের রক্ষার চেষ্টা করেছে, কাদের সঙ্গে অপরাধীদের যোগাযোগ ছিল তা শনাক্ত করলেই অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের নাম বের হয়ে আসবে। আমি দৃঢ়কণ্ঠে বলতে চাই, ছাত্রলীগের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমার নামে কোনো গ্রুপ নেই। আমি ছাত্রলীগের রাজনীতি দেখভাল করি না। আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক ও শেখ হাসিনার একজন কর্মী হিসেবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। তাই ছাত্রলীগের ভালো-মন্দ কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমার নাম না জড়ানোর জন্য সাংবাদিক ভাইদের প্রতি অনুরোধ করছি।
ধর্ষকদের শাস্তি দাবি রনজিতের: ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের শাস্তি দাবি করেছেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক রনজিত সরকার। শনিবার এ বিষয়ে নিজের ফেসবুক একাউন্টে দেয়া এক স্ট্যাটাসে রনজিত সরকার লেখেন- ‘পূণ্যভূমি সিলেটে এমন নিকৃষ্ট ঘটনা ঘটবে তা আমাদের কল্পনাতীত ছিল, এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ১৯৭১ সালে পাকিস্থানি হায়েনাদের কর্মকাণ্ডকেও হার মানিয়েছে। স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে নিয়ে স্বামীর সামনে যারা ধর্ষণ করছে তারা মানুষ নয় হায়েনা তাদের কোনো দল, গোত্র, দেশ কিংবা মানুষ নামে পরিচয় থাকতে পারেনা। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদ জানানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আমি আমার অবস্থান থেকে এদের বিরুদ্ধে কঠোর থাকবো, সবাইকে কঠোর থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। এদের বিচারের জন্য পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিতে সবাই যার যার অবস্থান থেকে সোচ্চার থাকবেন। নরপশুদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি।’