সিলেট: ক্ষোভে উত্তাল এমসি কলেজ। এই ক্ষোভের ঢেউ এখন গোটা সিলেটে। বেড়াতে আসা গৃহবধূকে স্বামীর সামনেই গণধর্ষণের ঘটনায় নিন্দার ঝড় সর্বত্র। এমন ঘটনা অতীতে কখনো এমসি কলেজের শতবর্ষের ইতিহাসে ঘটেনি। ‘বিতর্কিত’ টিলাগড় গ্রুপের ছাত্রলীগের একাংশের কর্মীরা এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিলো এমসি’র ক্যাম্পাসে। ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল দুপুরে এমসি’র ফটকে দুই ঘণ্টা বিক্ষোভ করেছে সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের একাংশ। এ সময় তারা টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করে। এদিকে- আলোচিত ধর্ষণের ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
তবে- ঘটনায় দু’টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনায় একটি ও অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় আরেকটি মামলা। কলেজ কর্তৃপক্ষ দুপুরে এক জরুরি বৈঠক করে ঘটনায় তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। বলেছে- জড়িতদের ছাত্রত্ব বাতিল করা হবে। বৃষ্টি উপেক্ষা করে সিলেট নগরীতেও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী এলাকার এক দম্পত্তি গতকাল সন্ধ্যায় নিজেদের গাড়ি নিয়ে এমসি কলেজে বেড়াতে আসেন। তারা প্রথমে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখেন। পরে তারা এমসি’র শতবর্ষী ছাত্রাবাস দেখতে যান। প্রাইভেট গাড়ি নিয়েই তারা ক্যাম্পাসে ঢুকেন। রাত তখন ৮ টা। এ সময় ছাত্রলীগের রঞ্জিত গ্রুপের কর্মী সাইফুর ও রনির নেতৃত্বে ৯-১০ জন কর্মী ওই দম্পত্তির কাছে আসে। এসেই তারা জোরপূর্বক স্বামীর কাছ থেকে বধূকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। সঙ্গে নিয়ে যায় গাড়িও। পিছু পিছু স্বামী দৌড়ে গিয়ে দেখেন তার স্ত্রীকে সাইফুর ও রনির নেতৃত্বে হোস্টেলের নতুন ভবনের সামনে ধর্ষণের চেষ্টা চালাচ্ছে। এ সময় তিনি বাধা দেন। তাকে ছাত্রলীগ কর্মীরা বেধড়ক মারধর করে। এক পর্যায়ে বেঁধে রাখে। এরপর প্রাইভেট কারের ভেতরেই তারা পর্যায়ক্রমে ওই বধূকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের সময় গৃহবধূ ও তার স্বামী চিৎকার করলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। পরে পুলিশ গিয়ে তাদের উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি করে। এ ঘটনার খবর পেয়ে রাত ১০ টায়ই ঘটনাস্থলে ছুটে যান সিলেট মহানগর পুলিশের ডিসি (দক্ষিণ) সোহেল রানা। এরপর থেকে পুলিশ ধর্ষকদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করে। রাতেই পুলিশের একটি দল নবনির্মিত হলের শাহ্ রনির ২০৫ নম্বর কক্ষ ও ৪ নম্বর ব্লকের সাইফুরের কক্ষে অভিযান চালায়। এ সময় সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে- সাইফুরের কক্ষ থেকে পুলিশ একটি আগ্নেয়াস্ত্র ও রনির কক্ষ থেকে দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করেছে। এ ঘটনায় ভোররাত ৪ টার দিকে ধর্ষিতার স্বামী ও নগরীর শিববাড়ী এলাকার বাসিন্দা বাদী হয়ে শাহ্পরাণ থানায় মামলা করেন। মামলায় ৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এজাহারনামীয় আসামিরা হলো, এম. সাইফুর রহমান, শাহ্ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেক আহমদ, অর্জুন লস্কর, রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান। এদের সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আসামিদের মধ্যে তারেক ও রবিউল বহিরাগত, বাকিরা এমসি কলেজের ছাত্র। তবে শাহ্ রনি গত বছর এমসি কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করলেও হলের রুম তার দখলেই ছিল। আর সাইফুর শিক্ষকদের বাংলো দখল করে বসবাস করতো। এদিকে- ধর্ষণ মামলা দায়েরের পর গতকাল সকালে পুলিশ বাদী হয়ে সাইফুর ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করেছে। দু’টি মামলা দায়ের করা হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় ক্ষোভ দেখা দেয়। দুপুরে এমসি কলেজের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার গোলাম কিবরিয়া। এ সময় তিনি মানবজমিনকে জানান- ঘটনার পর থেকে পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযানে রয়েছে। পুলিশ এখন আসামি গ্রেপ্তারের পাশাপাশি ঘটনার তদন্তও চালাবে। এদিকে- দুপুরের পর বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে এমসি কলেজের প্রধান ফটকের সামনে। সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের একাংশের কর্মীরা সিলেট-তামাবিল সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এক পর্যায়ে তারা টায়ার জ্বালিয়েও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তাদের বিক্ষোভের কারণে দুপুর সাড়ে ১১ টা থেকে ১ টা পর্যন্ত তামাবিল সড়কে যানবাহন চলাচল করতে পারেনি। বিক্ষোভের সময় এমসি কলেজের অধ্যক্ষ সালেহ আহমদ এসে একাত্মতা প্রকাশ করেন। এ সময় তিনি বলেন- এ লজ্জা কোথায় রাখবো। এমসি কলেজের ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি। যারা জড়িত তাদের ছাত্রত্ব বাতিলের ঘোষণা দেন তিনি। বলেন- ধর্ষকদের স্থান এমসি কলেজে হবে না। এদিকে- দুপুরে কলেজের অধ্যক্ষ সিনিয়র শিক্ষক ও হল সুপারদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে তিনি তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটির প্রধান করা হয়েছে প্রফেসর আনোয়ার হোসেন চৌধুরীকে। আগামী ৭ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে। কমিটিতে দুই হোস্টেল সুপারকে সদস্য করা হয়েছে। অধ্যক্ষ জানান- ঘটনার জন্য কলেজ ছাত্রাবাসের দুই দারোয়ানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কারণ- করোনার শুরু থেকেই এমসি কলেজের ছাত্রাবাস বন্ধ। টিউশনির জন্য কিছু ছাত্র হলে বসবাস করতো। আর ধর্ষকদের বার বার হোস্টেল থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এরপরও তারা চলে আসতো। আড্ডা দিতো। এগুলো তাদের জানার বাইরে ছিল। এদিকে- গতকাল বাদ আসর নগরীর কাজীরবাজার জামেয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি কোর্ট পয়েন্টে এসে সমাবেশে মিলিত হয়। এ সময় ওই মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা জানান- ধর্ষকদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে কঠোর কর্মসূচি গ্রহন করা হবে। গণধর্ষণের প্রতিবাদে সিলেটে মিছিল ও সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ। শনিবার বেলা ১ টায় সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে সাধারণ ছাত্রদের মিছিল শুরু হয়ে নগরের বন্দরবাজার ঘুরে চৌহাট্টা পয়েন্টে এসে শেষ হয়। পরে সেখানে পথসভা করেন ছাত্ররা। ছাত্র অধিকার পরিষদ সিলেট বিভাগীয় কমিটির সহ-সমন্বয়ক আব্দুল্লাহ আল সুজনের পরিচালনায় সমাবেশে বক্তরা বলেন- দীর্ঘদিন ধরে এমসি কলেজসহ সারা দেশে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী কার্যক্রম করছে। অতীতে এই সন্ত্রাসীরা এমসি কলেজের ছাত্রাবাস পুড়িয়েছিল। নিজের দলীয় কর্মীদের খুন করেছিল তারা। পুরো সিলেটের ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা হত্যা, চাঁদাবাজি ও ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত। বক্তারা আরও বলেন, এই ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচার করতে হবে। টিলাগড় এলাকায় যেসব গডফাদার এই সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেয় তাদেরও বিচার করতে হবে। যেহেতু ধর্ষকরা ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী তাই তাদের এই ঘটনায় অবশ্যই দায় নিতে হবে। বক্তারা, এমসি কলেজের অধ্যক্ষ ও শাহ্পরাণ থানার ওসি’র পদত্যাগের দাবি জানান। ছাত্র অধিকার পরিষদ সিলেট বিভাগীয় কমিটির সমন্বয়ক নাজমুস সাকিব বলেন, অতীতে ছাত্রলীগের কোনো অপকর্মের বিচার না হওয়াতে তারা বারবার অপরাধ করছে। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার না করলে ছাত্র অধিকার পরিষদ কঠোর কর্মসূচি দিবে বলে ঘোষণা দেন তিনি। ঢাকার সরকারি তিতুমীর কলেজ ছাত্র অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক সোহেল মৃধা বলেন- ধর্ষকরা যে দলেরই হোক ছাত্র অধিকার পরিষদ এর সর্বোচ্চ বিচার চায়। প্রয়োজনে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ধর্ষণ সহ সকল অন্যায়ের বিচার নিশ্চিত করা হবে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ছাত্র অধিকার পরিষদ সিলেটের সদস্য এইচএম আক্তার, ইফতেখার মো. নাবিল চৌধুরী, মো. ফয়সল আহমদ, সামাদ আহমদ, পাপলু আহমদ, নাঈম আহমদ, সালমান আহমদ, মাজেদ আহমদ, ইকবাল আহমদ, মারুফ ফারহান, মাসুদ আহমদ, শাহরিয়ার আহমদ শাহরিয়া, ইমরান আহমদ, নুরুল হুদা লস্কর, জাবেদ আহমদ, ইমরান চৌধুরী, মুসা মিয়া প্রমুখ। স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, সিলেটের পবিত্র মাটিতে ধর্ষণের মতো একটি ঘৃণ্য ঘটনা কখনোই মেনে নেয়া যায় না। ১২৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করে নষ্ট রাজনীতির ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসীরা একের পর এক ঘৃণ্য ঘটনার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। ধর্ষণ ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়েও অপরাধীরা বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায়। এর পূর্বেও এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাস ছাত্রলীগের নামধারী ক্যাডাররা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এখনও পর্যন্ত একটি ঘটনার সুষ্ঠু বিচার আমরা দেখতে পাইনি।
সিলেটের বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দের নিন্দা ও বিচার দাবি: এমসি কলেজে তরুণী গণধর্ষণের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ, নিন্দা ও ধর্ষকদের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন সিলেটের বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ। শনিবার এক যৌথ বার্তায় নেতৃবৃন্দ বলেন- এমসি কলেজ হোস্টেলে ৬ ছাত্রলীগ নেতা কর্তৃক তরুণী গণধর্ষণের ঘটনা কোনোভাবে মেনে যায় না। ঐতিহ্যবাহী ক্যাম্পাসের মতো নিরাপদ স্থানে এই ধরনের ঘটনা গোটা জাতিকে স্তম্ভিত করেছে। এই গণধর্ষণের ঘটনায় সারা দেশের মতো সিলেটবাসী মর্মাহত। তার দায় শাসকদল কোনোভাবে এড়াতে পারে না। নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে এমসি কলেজ হোস্টেলে গৃহবধূ গণধর্ষণকারী ছাত্রলীগ নেতাদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতি ব্যারিস্টার মো. আরশ আলী, সিলেট জেলা জাসদ সভাপতি লোকমান আহমদ, সিপিবি’র সাবেক সভাপতি এডভোকেট বেদানন্দ ভট্টাচার্য, প্রবীণ আইনজীবী মুজিবুর রহমান চৌধুরী, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম, সাম্যবাদী দলের জেলা সম্পাদক ধীরেন সিংহ, সিপিবি জেলা সভাপতি হাবিবুল ইসলাম ৎ খোকা, গণতন্ত্রী পার্টির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রকৌশলী আইয়ুব আলী, বিশিষ্ট আইনজীবী এমাদ উল্ল্যাহ শহিদুল ইসলাম, সুজন সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী, বাংলাদেশ জাসদ মহানগর সভাপতি জাকির আহমদ, বাসদ (মার্কসবাদী) আহ্বায়ক উজ্জ্বল রায়, বাসদ সমন্বয়ক আবু জাফর, সিপিবি সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আনোয়ার হোসেন সুমন, জাসদ জেলা ও মহানগর সাধারণ সম্পাদক কেএ কিবরিয়া ও গিয়াস আহমদ, বাংলাদেশ জাসদ মহানগর সাধারণ সম্পাদক নাজাত কবির, গণতন্ত্রী পার্টি জেলা সাধারণ সম্পাদক জুনেদুর রহমান চৌধুরী, মানবাধিকার ডিফেন্ড এর জেলা সদস্য সচিব লক্ষ্মী কান্ত সিংহ, বাসদ জেলা সদস্য জুবায়ের আহমদ চৌধুরী সুমন, বাসদ (মার্কসবাদী) সদস্য এডভোকেট হুমায়ুন রশীদ শোয়েব, বাসদ (মার্কসবাদী) পাঠচক্র ফোরামের সমন্বয়ক সুশান্ত সিনহা সুমন, বাসদ নেতা প্রণব জ্যোতি পাল, যুব ইউনিয়ন সভাপতি খায়রুল হাছান, আইনজীবী রণেন রনি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের মহানগর সভাপতি সঞ্জয় কান্ত দাশ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট আহ্বায়ক সঞ্জয় শর্মা, ছাত্র ইউনিয়ন জেলা সাধারণ সম্পাদক নাবিল এইচ।