পুলিশের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক। আর প্রত্যাশা অনুসারে সেবা না পেলেই পুলিশের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়। তারপরও নানা সমস্যায় মানুষকে যেতে হয় পুলিশের কাছেই। সমস্যা-সংকটে ভরসার জায়গা পুলিশ। নানা প্রতিকূলতার মধ্য থেকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন এই বাহিনীর সদস্যরাও। সীমাবদ্ধতার মধ্যেও লড়ে যাওয়া পুলিশের বিরুদ্ধে মানুষের অভিযোগেরও শেষ নেই। নানা সময়ে পুলিশ সদস্যদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় পুরো বাহিনীকে। বাহিনী সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাহিনীতে থেকে কেউ অপরাধ করলে এর দায় পুরো বাহিনীর নয়।
যারা অপরাধে জড়ায় তাদের বিরুদ্ধে বাহিনী ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। বাহিনীতে থেকে জনস্বার্থবিরোধী যেকোনো কাজ অপরাধের শামিল। এটি তদারকির জন্য পুলিশের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা রয়েছে। পুলিশের সাবেক কর্মকর্তাদের মতে কেন্দ্র থেকে কঠোর নজরদারি বাস্তবায়ন হলে কতিপয় পুলিশ সদস্য অনিয়ম করে পুরো বাহিনীর সুনাম নষ্ট করতে পারবে না। একইভাবে তৃণমূল পর্যন্ত নজরদারি থাকলে সেবাদান প্রক্রিয়াও আরো স্বচ্ছ হবে। পুলিশের বর্তমান আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ দায়িত্ব নেয়ার পর অতীতের ধারাবাহিকতায় নানামুখী চেষ্টা করছেন পুলিশের কার্যক্রম আরো বেগবান করতে। সেবা বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা জোরদার করতে নেয়া হচ্ছে নতুন নতুন পরিকল্পনা।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। এর মাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ৩১শে জানুয়ারি পর্যন্ত আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এ কে এম শহীদুল হক। ওই সময়ে দেশের অন্তত ১৬টি জেলায় জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, জঙ্গিদের মূলোৎপাটন করতে তৎপরতা চালানো হয়। এ জন্য তাদের আস্তানা, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুঁজে বের করে অভিযান চালানো হয়েছে। সার্বক্ষণিক এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নজরদারি করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরে এ জন্য একটি মিনি গোয়েন্দা টিম করা হয়েছিলো। গোয়েন্দা সূত্রে ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সারা দেশে জঙ্গিদের নজরদারি করা হতো। এই টিমে পুলিশের কিছু চৌকস অফিসার ছিলেন। তারা অনেক শ্রম দিয়েছেন। তিনি বলেন, এ ছাড়া পুলিশের অর্জন অনেক। তবে ক্ষমতা হাতে থাকায় কিছু সদস্য হয়তো নিজের স্বার্থে বাহিনীর সুনাম নষ্ট হয়- এমন কাজ করে। এটি নিয়ন্ত্রণে বাহিনীতেই ব্যবস্থা আছে। তা কঠোরভাবে পালন করতে হবে।
সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, পুলিশকে সব সময় দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হয়- জনশৃঙ্খলা ও অপরাধ। জনশৃঙ্খলা ঠিক থাকলে অপরাধ কম হয়। পুলিশের অর্জন অনেক। এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। মানুষের আস্থা অর্জন হয়, সুনাম বৃদ্ধি পায়- এ ধরনের কাজ বেশি করতে হবে। কিছু সদস্যের জন্য যাতে তা প্রশ্নবিদ্ধ না হয় এ জন্য মনিটরিংকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রয়োজনে পুলিশ কর্মকর্তা ছাড়াও সিভিল সোসাইটির লোক নিয়ে মনিটরিং সেল হতে পারে। সাবেক এই আইজিপি বলেন, পুলিশ সদস্যরা অনেক কষ্ট করেন। এক একজন সদস্য ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত ডিউটি করেন। এরমধ্যেই পুলিশ ভালো ভালো কাজ করছে।
পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিসি (ডিবি) সৈয়দ বজলুল করিম বলেন, পুলিশ হচ্ছে সুশৃঙ্খল সমাজের নির্মাতা। বাংলাদেশের পুলিশ জনবান্ধব হতে চেষ্টা করছে। জনতার পুলিশ হতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে মহামারি করোনার সময়ে পুলিশ মানুষকে সেবা দিয়ে মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কিন্তু কিছু সদস্যের অপেশাদার আচরণের জন্য এসব অর্জন যেনো ম্লান না হয় সেদিকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টি রাখতে হবে।
পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করেন, দেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সামগ্রিকভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো। দেশে প্রায় ২ লাখ ১০ হাজার পুলিশ সদস্য রয়েছেন। জাতিসংঘের মান অনুসারে পুলিশের আদর্শ অনুপাত হচ্ছে ৪০০:১। দেশে এই অনুপাত হচ্ছে ৮২২:১। যে কারণে সেবা দিতেও বেগ পেতে হয় পুলিশকে। পুলিশের পরিদর্শক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, একজন পুলিশ সদস্যকে দৈনিক ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত ডিউটি করতে হয়। বাসায় থেকেও অন ডিউটিতে থাকতে হয়। দেখা গেছে ডিউটি যখন শেষ পর্যায়ে বা বাসায় আসার পর জানা গেল কোথাও একটি লাশ পাওয়া গেছে। সেখানে ছুটে যেতে হয়। তারপর লাশ উদ্ধার। সুরতহাল রিপোর্ট থেকে শুরু করে হাসপাতালের মর্গ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে হয় পুলিশকে। অপরাধ দমন এবং তদন্ত করা পুলিশের নিয়মিত কাজ। এ জন্য মামলা গ্রহণ, ঘটনাস্থল পরিদর্শন, আসামি গ্রেপ্তার, আদালতে হাজির করা, তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে হয়। এর বাইরেও মাঠ পর্যায়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করতে হয় পুলিশকে।
ভিআইপিদের নিরাপত্তা, সভা-সমাবেশের নিরাপত্তা, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নিরাপত্তায় ব্যস্ত থাকতে হয় পুলিশ সদস্যদের। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, পুলিশের নিয়মিত টহল ও অভিযানের কারণে রাস্তাঘাটে চুরি, ছিনতাই অনেক কমে গেছে। ছিনতাই প্রতিরোধে গোয়েন্দা পুলিশ আলাদা টিম গঠন করে কাজ করছে দীর্ঘদিন থেকে। ছিনতাইকারীদের শনাক্ত করে নিয়মিত তাদের নজরদারি করার কারণেই ছিনতাই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা মনে করছেন।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, দেশে আইন মেনে চলার সংস্কৃতি গড়ে উঠেনি। তাই আইন প্রয়োগ করতে হয়। দেখা গেছে, যেখানে সিসি ক্যামেরা রয়েছে সেখানে অপরাধ কম হচ্ছে। একইভাবে পুলিশ সদস্যরাও সেখানে পেশাদারিত্ব বজায় রাখছেন। যে কারণে অপরাধ দমনে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারকে গুরুত্ব দিচ্ছে পুলিশ।
পুলিশের আধুনিকীকরণ এবং সক্ষমতা বাড়াতে যুগোপযোগী তথ্য প্রযুক্তির প্রয়োগ, উন্নতমানের অস্ত্র ও গাড়িসহ লজিস্টিক সাপোর্ট, গোয়েন্দা তথ্য ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, প্রযুক্তিগত তদন্ত ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি সোহেল রানা বলেন, তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষ করতে থানা পুলিশকেও প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও প্রতিটি জেলায় একটা বিশেষ ইউনিট রয়েছে। তারা তথ্য প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ অনেক মামলা তদন্তে এসব সক্ষমতা কাজে লাগানো হচ্ছে। পিবিআই, সিআইডি, ডিবি’সহ পুলিশের প্রতিটি ইউনিট অপরাধ দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অতীতের তুলনায় পুলিশ অনেক মানবিক। করোনা পরিস্থিতিতে আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়ে, সেবা দিয়ে তা প্রমাণ করেছে পুলিশ।
নীরবে কাজ করছে পিবিআই: প্রতিষ্ঠার পর ২০১৬ সাল থেকে মামলা তদন্ত শুরু করে পিবিআই। এ পর্যন্ত ৪৮ হাজার ৪৪৬টি মামলা তদন্ত শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। তদন্ত করছে ছয় সহস্রাধিক মামলা। আলোচিত মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে সগীরা মোর্শেদ হত্যা মামলা, নুসরাত জাহান হত্যা মামলা, এলিট সিকিউরিটি ফোর্স শামীম হত্যা মামলা। ২০১৯ সালের ৬ই এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে হত্যা করা হয়। আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালানোর অপচেষ্টা করে খুনিরা। সেই চাঞ্চল্যকর মামলাটি তদন্ত করে অল্পদিনের মধ্যেই চার্জশিট প্রদান করে পিবিআই। ওই মামলায় ১৬ আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন আদালত। ১৯৮৯ সালের ২৫শে জুলাই ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে হত্যা করা হয় সগীরা মোর্শেদকে। মামলাটি ভিন্নখাতে নিয়ে প্রভাবশালী আসামিদের রক্ষা করা হয়েছিল। সেই মামলা তদন্ত ও আসামিদের গ্রেপ্তার করে পিবিআই। অন্তত এক ডজন মামলা যা সুরতহালে আত্মহত্যা ছিল এবং পূর্বের তদন্তে ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়েছিল। সেসব মামলা তদন্ত করে হত্যাকাণ্ডের তথ্য প্রমাণ উদ্ঘাটন করেছে পিবিআই। পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, আমাদের কৌশল মূলত তদন্ত। তদন্তকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেই। ভিজিটরকে প্রাধান্য দেই। তাদের দেয়া তথ্য যাচাই করি। এক্ষেত্রে অনেক তথ্যই কাজে লাগে। তাছাড়া ফিঙ্গার প্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন ও ভেরিফিকেশন সিস্টেম, অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি, ল্যাব ব্যবহার করছে পিবিআই।
সীমিত সক্ষমতা নিয়ে লড়ছে সিআইডি: চাঞ্চল্যকর অনেক মামলার ক্লু উদ্ঘাটন ও আসামি গ্রেপ্তার করছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। দীর্ঘ ৫ বছর পর নরসিংদীর চাঞ্চল্যকর শিশু ইলমা বেগম (১১) হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করেছে সিআইডি। ২০১৫ সালের ২৮শে মার্চ নরসিংদীর বাহেরচর গ্রামের ধানক্ষেতে পাওয়া যায় দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী ইলমার লাশ। সিআইডির তদন্তে প্রকাশ পায়, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ৩০ লাখ টাকার বিনিময়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে সম্মত ও সহায়তা করে ইলমার পিতা আব্দুল মোতালেব।
লিবিয়ায় গত ২৮শে মে ২৬ জন বাংলাদেশি হত্যার পর এই চক্রের ৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। মানব পাচারের অভিযোগে কুয়েতে গ্রেপ্তার বাংলাদেশের এমপি কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল’র সহযোগী দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। ভুয়া ভিসা দিয়ে তারা সাধারণ মানুষকে কুয়েতে নিয়ে প্রতারণা করতো। একইভাবে দুবাইয়ে নারী পাচারকারী মো. আজম ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। সর্বশেষ গ্রেপ্তার করা হয় নৃত্যশিল্পী ইভান শাহরিয়ারকে। দীর্ঘ আট বছর ধরে দুবাইয়ে ড্যান্স ক্লাবে নারী পাচার করতো এই চক্র। বাধ্য করতো অনৈতিক কাজে। সমপ্রতি নাইজেরিয়ান, আফ্রিকান অর্ধশত নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। খেলোয়াড়, পর্যটক ও শিক্ষার্থী হিসেবে বাংলাদেশে এসে নানা অপরাধ সংঘটন করে এই চক্র। ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতারণা করে বিপুল টাকা লুটে নেয়।
ক্যাসিনো ব্যবসায়ীসহ অপরাধীদের বিদেশে টাকা পাচারের বিষয়ে মামলা ও তদন্ত করছে সিআইডি। দিয়েছে কয়েকটি মামলার চার্জশিটও। এ ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলে ভর্তির প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মোহাম্মদ জিসান জানান, জনবলসহ নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও কাজের ক্ষেত্রে সিআইডি যথেষ্ট তৎপর।
কাউন্টার টেরোরিজম, সক্ষমতার চেয়েও সফলতা বেশি: পুলিশের বড় অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে জঙ্গি দমন। ২০১৮ সালের পর জঙ্গিদের তৎপরতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ২০১৬ সালের ১লা জুলাই রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনাটি এ পর্যন্ত জঙ্গিদের সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। এই জঙ্গি হামলার পর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি বিশেষ বিভাগ কাজ শুরু করে। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট নামের এই বিভাগটি এখন সারা দেশে সমপ্রসারিত করা হয়েছে। রয়েছে ‘সোয়াত’ নামের র্যাপিড রেসপন্স টিম।
সার্বক্ষণিক সাইবার টহল, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জঙ্গি প্রতিরোধে ভূমিকা রাখছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। ২০১৬ সালে ১৬ই ফেব্রুয়ারি ৪০০ জনবল সিটিটিসি’র যাত্রা শুরু। প্রতিটি জঙ্গি হামলার তদন্ত, একের পর এক অভিযান ও জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করে জঙ্গি দমনে সফলতা দেখিয়েছে সিটিটিসি। সিটিটিসির ১৯টি সরাসরি অপারেশনে মোট ৬৩ জন নিহত হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে আট জন। এ ছাড়াও সাইবার অপরাধী ও জঙ্গিসহ মোট ৫৩৫ জন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রায়ই জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। একইভাবে অল্প জনবল নিয়ে জঙ্গি দমনে কাজ করছে পুলিশের এন্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)। ২০১৮ সালে কার্যক্রম শুরু হলেও তৎপরতায় বেশ এগিয়ে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগের জঙ্গি এবং আজকের জঙ্গিদের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। ওই সময়ে ম্যানুয়াল সিস্টেমে কাজ করতো। ফেরিওয়ালাসহ নানা পেশার ছদ্মবেশে জঙ্গি তৎপরতা চালাতো। যোগাযোগ হতো চিঠির মাধ্যমে। তখন একজনকে গ্রেপ্তার করলে তাদের কাছ থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যেতো। প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গিরা অপরাধ সংঘটনে এর সুবিধা নিচ্ছে। তারা নিত্যনতুন বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখে। সহজেই বিভিন্ন দেশের জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছে।
পুলিশের এন্টি টেরোরিজম ইউনিটের এডিশনাল ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান বলেন, পুলিশে টানা অভিযানে জঙ্গিরা তৎপরতা প্রায় থামিয়ে দিয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র ছাড়াও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের গতিবিধিতে নজর রাখছে পুলিশ। বাড়ানো হয়েছে সাইবার পেট্রোলিং। নাশকতার বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও বাস্তবায়নের আগেই তা জেনে যাচ্ছে পুলিশ। যে কারণে জঙ্গি তৎপরতা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। এ ছাড়াও জঙ্গি নাশকতা প্রতিরোধে সক্ষমতা বাড়াতে প্রায় অর্ধশত পুলিশ সদস্যকে কমান্ডো ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। পুলিশ সদস্যদের বিদেশেও উন্নত প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।
যা করছে সিটিটিসি’র সাইবার ইউনিট: পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের এডিসি নাজমুল ইসলাম বলেন, অপরাধের ধরন পাল্টেছে। সরাসরি ছাড়াও সাইবার মাধ্যমে যৌন হয়রানি, নগ্ন ছবি, ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটছে বেশি। এক্ষেত্রে ভিকটিমকে যথাযথ নিরাপত্তা দিয়ে তদন্ত করা হয়। এসব ক্ষেত্রে ভিকটিমরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তাদের এক ধরনের কাউন্সেলিং করা হয়। প্রায় প্রতিটি অভিযোগ দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
৯৯৯, বিশ্বমানের সেবার এক প্ল্যাটফরম: যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অপরাধ প্রতিরোধে তাৎক্ষণিক হেল্প লাইন ৯৯৯ সংযোজনের পর সাধারণ মানুষ বেশ উপকৃত হচ্ছে। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও এম্বুলেন্স সেবাদানের জন্য ২০১৬ সালের পরীক্ষামূলক ৯৯৯ এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ওই সময়ের গৃহীত কল বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ৬৪.৮০ ভাগ পুলিশি সেবা, ৩১.১০ ভাগ ফায়ার সার্ভিস ও ৪.১০ ভাগ এম্বুলেন্স সেবার জন্য কল করেন। ২০১৭ সল থেকে দেশের সব মানুষকে টেলিফোন ও মোবাইল ফোনভিত্তিক জরুরি সেবার আওতায় আনা যায়। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষকে সেবা দেয়া হচ্ছে ৯৯৯ থেকে। কোনো অপরাধ সংঘটনের খবর দেয়া হলে তাৎক্ষণিক সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হচ্ছে। গ্রেপ্তার করা হচ্ছে অপরাধীদের। দেয়া হচ্ছে অন্যান্য সেবাও। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি সময়োপযেগী বাহিনী হিসেবে পুলিশকে গড়ে তোলার পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। নানা কারণে পুলিশের ওপর মানুষের যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে সেবার মাধ্যমে তা দূর করার চেষ্টা করতে হবে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো এড়াতে কেন্দ্র থেকে তদারকি বাড়ানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।