সারা দেশের ৬৮ কারাগারের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। কারা ফটকগুলোতে কারারক্ষী ছাড়াও পুলিশ, র্যাব নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। সাদা পোশাকে রয়েছে গোয়েন্দারা। চিঠি পাঠিয়ে ও ফোনে কারাবন্দি জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেয়ার হুমকি দেয়ার পর সারা দেশের কারা কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মোস্তফা পাশা। গত রোববার ‘অতীব জরুরি’ হিসেবে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে কারা মহাপরিদর্শক এই চিঠি পাঠান। সোমবার থেকেই পাল্টে যায় কারাগারের দৃশ্যপট। গড়ে তোলা হয়েছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে গিয়ে দেখা গেছে, ফটকের সামনে সশস্ত্র অবস্থায় দায়িত্ব পালন করছেন কারারক্ষীরা। দর্শনার্থীদের ক্ষেত্রে ছিল কঠোর সতর্কতা।
আশেপাশে ছিল পুলিশের অবস্থান। কারাগারের সংযোগ সড়ক থেকে শুরু করে টাওয়ার ও ফটকে রয়েছে কারারক্ষী ও পুলিশের অবস্থান। সীমানা প্রাচীরের বিভিন্ন স্থানে ৪০ ফুট চারটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে আশেপাশের এলাকা নজরদারি করা হচ্ছে। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ জামাল মানবজমিনকে জানান, পুলিশ নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সেখানে আগে থেকেই ৩০-৪০ জন পুলিশ সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতো। কারাগারের নিরাপত্তার জন্য সেখানে পুলিশের একটি ক্যাম্প রয়েছে। তারপরও হুমকির বিষয়টি জানার পর নিরাপত্তা আরো জোরদার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
কারা মহাপরিদর্শকের নির্দেশনা অনুসারে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ও অস্ত্র নিয়ে ডিউটি করছেন কারারক্ষীরা। ইতিমধ্যে কারারক্ষী ও কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে স্ট্রাইকিং ফোর্স গঠন করা হয়েছে। সারা দেশের ৬৮টি কারাগারেই নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। কারা অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত জেলা কারাগারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে নিরাপত্তা ব্যবস্থার খোঁজখবর রাখছেন। কারা সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার বাইরে কাশিমপুর, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁওসহ যেসব কারাগারে জঙ্গি, শীর্ষ সন্ত্রাসী রয়েছে সেসব কারাগারকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
সূত্রমতে, কয়েক দিন পূর্বে লালমনিরহাটের জেল সুপারের কাছে একটি চিঠি আসে। ওই চিঠিতে যে কোনো মূল্যে কারাগারে আটকে থাকা জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেয়ার হুমকি দেয় দুষ্কৃতকারীরা। এমনকি চিঠির পরে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ফোন করেও একই হুমকি দেয়। পরে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়। লালমনিরহাটের জেল সুপার কিশোর কুমার নাগ সাংবাদিকদের জানান, ওই কারাগারে ২০ জন জঙ্গি রয়েছে। তাদের ছিনিয়ে নেয়ার জন্য উড়োচিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠি পাওয়ার পর থেকেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
উড়ো চিঠি ও ফোনে হুমকি পাওয়ার পর গত রোববার দেশের কারাগারে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য চিঠি দেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মোস্তফা পাশা। চিঠিতে ঝুঁকি এড়াতে ১৮টি নির্দেশনা দেন তিনি।
সংগ্রহে থাকা ওই চিঠিতে দেখা গেছে, কারাগারের অস্ত্রাগার থেকে প্রয়োজনীয় মুহূর্তে যেন দ্রুত অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করা যায় সেজন্য প্রয়োজনীয় মহড়া আয়োজন করতে হবে। কারাগারের চারপাশের সীমানাপ্রাচীর সুরক্ষিত রেখে এবং অ্যালার্ম সিস্টেম পরীক্ষা করে প্রস্তুত করে রাখতে হবে। কারাগারে আটক জঙ্গি, আইএস, শীর্ষ সন্ত্রাসী, বিডিআর ও বিভিন্ন সংবেদনশীল মামলায় আটক বন্দিদের চলাচল ও গতিবিধি কঠোরভাবে নজরদারি করতে হবে। যেসব কারাগারে এ ধরনের জঙ্গি বন্দি রয়েছে সেসব এলাকার পুলিশ প্রশাসনকে বিষয়টি জানিয়ে তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। প্রতিটি কারাগারে একজন ডেপুটি জেলার, একজন প্রধান কারারক্ষী ও পাঁচজন কারারক্ষীর সমন্বয়ে একটি স্ট্রাইকিং ফোর্স গঠন করে সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধে প্রস্তুত থাকতে হবে। কারাগারের বাইরের ফটকে দায়িত্বপালনকারীদের বুলেট প্রুফ জ্যাকেট, হেলমেট পরতে হবে। আগতদের সর্তকতার সঙ্গে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তল্লাশি করতে হবে। ডিউটিতে সশস্ত্র সেন্ট্রি নিয়োগ দিতে হবে। অস্ত্র ও অস্ত্রাগারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়েও নির্দেশনা দেন কারা মহাপরিদর্শক।
২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে গুলি চালিয়ে ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। তারা হচ্ছে, গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারের (হাই সিকিউরিটি) আসামি রাকিব হাসান ওরফে রাসেল, সালাউদ্দিন ওরফে সজীব এবং বোমা মিজান ওরফে জাহিদুল হাসান সুমন। ২০১৭ সালে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী এলাকায় হামলা চালিয়ে হুজি নেতা মুফতি হান্নানকেও ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করেছিল জঙ্গিরা। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক থাকায় তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি জঙ্গিরা।
জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে গড়ে তালা পুলিশের বিশেষায়িত শাখা এন্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)’র এডিশনাল ডিআইজি মনিরুজ্জামান বলেন, জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার হুমকির বিষয়ে আমরা অবহিত। এসব হুমকিকে বিশ্লেষণ করি, গুরুত্ব দেই। এ বিষয়ে পুলিশ তৎপর রয়েছে। কারাগারগুলোতে নজরদারি করা হচ্ছে। তবে আমরা মনে করি, হামলা করে কারাগার থেকে জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার মতো শক্তি ও সামর্থ্য জঙ্গিদের এখন নেই।