সুইসাইট নোট না আগাম এজাহার! তদন্ত দরকার

Slider টপ নিউজ


গাজীপুর: গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর থানার তদন্ত পরিদর্শক আফজাল হোসেনকে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উঠায় তদন্তের স্বার্থে পুলিশ লাইনে ক্লোজড করা হয়েছে। আফজালের বিরুদ্ধে কারামুক্ত তিন সাংবাদিক নির্যাতনের অভিযোগে এনে একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আবেগঘন ষ্ট্যাটাস দিয়েছেন। “এই লেখাটাকে অন্ততঃ সুইসাইট নোট বলে চালিয়ে দিয়েন না” উল্লেখ করে দেয়া ষ্ট্যাটাসটির তদন্ত করা উচিত।

গত (৩১ মে ২০২০ইং) গাজীপুর সদর উপজেলার বাঘেরবাজার থেকে তিন সাংবাদিককে আটক করার পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। ওই মামলার বাদী হয়েছিল পরিদর্শক আফজাল।

মামলায় দৈনিক যোগফলের স্টাফ রিপোর্টার মোজাহিদকে এক নম্বর আসামি করে সম্পাদক আসাদুল্লাহ বাদলসহ মোট ৫ জনকে আসামি করা হয়েছিল। ওই মামলায় গ্রেপ্তার তিন সাংবাদিক ৯০ দিন কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্তি পায়।

কারাগার থেকে বের হওয়ার পর তিনদিন আগে সাংবাদিক মোজাহিদ নির্যাতনের বর্ণনা ফেসবুকে পোস্ট করেন। ওই বর্ণনা থেকে জানা যায়, থানা হেফাজতে ঐ তিন সাংবাদিককে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করেন পরিদর্শক আফজাল হোসেনসহ কয়েকজন পুলিশ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নির্যাতনের বর্ণনা দেওয়া সাংবাদিক ও অন্যান্য সচেতন ব্যক্তিরা তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

ওই স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো:

“গাজীপুরে আমাকেসহ তিন সাংবাদিককে সন্ত্রাসী স্টাইলে আটক করার পর একটি নোয়া গাড়িতে তুলে (জয়দেবপুর থানার তদন্ত পরিদর্শক আফজাল) এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করে। পরে থানায় নিয়ে দীর্ঘ তিন ঘন্টা নির্যাতনের পর তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পানি চাইলে আমাদের মুখে প্রস্রাব ঢেলে দেয় আফজাল!

ওই আটককৃত তিনজন হলেন, দৈনিক যোগফলের স্টাফ রিপোর্টার মোঃ মোজাহিদ (আমি), সদর উপজেলা প্রতিনিধি রুকুনুজ্জামান খান ও দৈনিক মুক্ত বলাকা’র স্টাফ রিপোর্টার মিলন শেখ।

পরে আটককৃতদের ব্যাপক মারধরের পরদিন মামলার এজাহার বদলের নাটকীয়তা শেষে আটকের ২০ ঘন্টা পর জয়দেবপুর থানার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা নম্বর ১ (৬) ২০ দায়ের করে ওইদিন সন্ধ্যায় আদালতে পাঠানো হয় আমাদের।

পরে দীর্ঘ ৯০ দিন কারাবাসের পর নির্যাতিত (অবহেলিত) সাংবাদিকরা গত শুক্রবার (২৮ আগস্ট ২০২০) দুপুর বারোটা ১৫ মিনিটে গাজীপুর কারাগার থেকে মুক্তি পায়। ওই নির্যাতনের প্রভাব এখনও তিনজনের শরীরেই রয়ে গেছে। আমার দুই হাতের কব্জিতে এখনও ঠিকমতো শক্তি পাইনা। শুধু তাই নয়, গতরাত থেকে আমার অবস্থা আশংকাজনক। হয়তো যে-কোনও সময় মারা যেতে পারি। আমি মারা গেলে এই লেখাটাকে অন্ততঃ সুইসাইট নোট বলে চালিয়ে দিয়েন না। গতরাত থেকে আমার অবস্থা আশংকাজনক। আমি মারা গেলে এর জন্য অনেকটাই দায়ী জয়দেবপুর থানার তদন্ত পরিদর্শক আফজাল।

আমি সরল চিত্তে জানাচ্ছি, আমরা গত রোববার (৩১ মে ২০২০) সদর উপজেলার বাঘেরবাজারে (ভাওয়াল মিডিয়া সেন্টারে) একটি অনুসন্ধানী খবর লেখার কাজ করছিলাম। পরে রাত পৌনে ১১ টায় কাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ফিল্মি স্টাইলে পরিদর্শক আফজালের নেতৃত্বে আমাদেরকে গাড়িতে তুলেই মারধর শুরু করে।

ওই সময় অর্থাৎ (গাড়িতে তোলার পর) জয়দেবপুর থানার তদন্ত পরিদর্শক আফজালের নেতৃত্বে তিনজনকেই শারীরিক টর্চার করেন এসআই সাদেক, এসআই আব্দুর রহমান, এএসআই খাইরুল ও এএসআই ইউনুস।

গাড়িতে মেরেই তারা ক্ষান্ত হননি! আমার গলায় দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে আফজাল বলেন, “বুড়িগঙ্গা নদীতে তোদের মতো ৭ টা সাংবাদিককে মেরে ফেলে দিছি, আমার কিছুই হয় নাই! আমাকে কিছুই করতে পারবিনা তোরা”! তোদের তিনজনকে মেরে ফেললেও কিছুই হবে না আমার”! তখন এএসআই ইউনুস তখন বলেন, “স্যার এদেরকে রাজেন্দ্রপুর জঙ্গলে নিয়ে ক্রসফায়ার দিয়া দেন। ঠিক তখনই পরিদর্শক আফজালের মোবাইলে যোগফল সম্পাদকের কল আসতে থাকে। তারা সম্পাদক জেনে ফেলছে ভেবে ক্রসফায়ারের চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে থানায় নিয়ে যায়। থানায় নেওয়ার পর তিনজনের উপরই শুরু হয় সংজ্ঞাহীন নির্যাতন।

আমাদেরকে থানায় নেওয়ার পর পরিদর্শক আফজাল আমার, রুকন ও মিলনের হাত, পা, চোখ এবং মুখ বেঁধে একটানা তিন ঘন্টা লাঠিপেটা করে। রাত দুইটার দিকে মুখ খোলার পর তৃষ্ণায় ‘পানি পানি’ করে চিৎকার করলে পরিদর্শক আফজাল প্যান্টের চেইন খুলে তিনজনেরই মুখে প্রস্রাব করে দেয়! পরে এসআই সাদেক, এসআই আব্দুর রহমান, এএসআই খাইরুল, এএসআই ইউনুস ও কনস্টেবল আনোয়ার আরও (বোতলে) প্রস্রাব করে তিনজনের মাথায় ঢেলে দেয়। পরদিন শার্টে দুর্গন্ধ থাকায় ২০ ঘন্টায় থানায় এক গ্লাস পানিও খাইনি। জেলে গিয় (১ জুন ২০২০) রাতে পানি ও খাবার খেয়েছিলাম।

প্রস্রাব মাথায় ঢালার সময় ভিডিয়ো করছিল এএসআই খাইরুল। প্রশ্রাবে তিনজনেরই পড়নের জামা কাপড় ভিজে গেছিল। শুধু তাই নয়, ভিডিয়ো করার সময় উপস্থিত সকল পুলিশ হাসাহাসি করছিল আর বলছিল আর জীবনে সাংবাদিকতা করবি ? তখন জুতা পড়া অবস্থায় পরিদর্শক আফজাল সাংবাদিক (মোজাহিদের) আমার দুইটা হাত পিষে পিষে বলছিল সাংবাদিকতা করার রস মিটিয়ে দেবো। তোরা পুলিশের নামে খবর লিখিস কেন ? পুলিশ কি তোদের বাপ লাগে ? সেই থেকেই দুইটা হাতেই আগের অর্ধেক শক্তিও পাইনা।

আমি দুইটা হাতই মুঠ করতে পারতাম না ওই নির্যাতনের পর থেকে। জেলে গিয়ে কয়েক দফা চিকিৎসা করার পর কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছিল, আমার দুই পায়ের পাতায় ও শরীরে দুইটা লাঠি ভেঙেছিল আফজাল, কোমরের নিচে হাঁটুর উপরে লাঠি ভেঙে চিকন চিকন লাটির শলা ঢুকে প্যান্ট রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল। ঠিকমতো হাঁটতে পারলেও দুইটা হাতেই বর্তমানে আগের মতো শক্তি পাচ্ছি না। গলায় যেভাবে চেপে ধরেছিল তখন মনে হয়েছিল আর এক সেকেন্ড এভাবে চেপে রাখলে মারা যাব। ওই সময়ের দাগ হওয়া গলায় এখনও চিন্হ আছে, এখনও ব্যাথা রয়ে গেছে।

সাংবাদিক রুকনকে লাঠি দিয়ে মারধরের পাশাপাশি এএসআই ইউনুস নাকেমুখে এলোপাথাড়ি মেরে তার চেহারা বিকৃত করেছিল। ওই সময়ের থানা ও জেলখানায় তোলা ছবিতে এর প্রমাণ রয়েছে। যদিও ধরা খাওয়ার ভয়ে ওই ছবিটা ডিলিট করে দিয়েছে জয়দেবপুর থানা পুলিশ।

সাংবাদিক মিলন শেখকে (আমাদের প্রায় সমপরিমাণ) লাঠিপেটা করার পাশাপাশি ডান পায়ের হাঁটুর পাঁচ ইঞ্চি নিচে রক্তাক্ত করে ফেলে। প্রায় দুই সপ্তাহ ঠিকমতো হাঁটতে পারিনি সে। শুধু তাই নয়, নির্যাতনের তীব্রতায় প্রায় ১৫ দিন নাকে কোনও গন্ধ পেতোনা। এখনও তার পায়ের ক্ষত চিন্হটা রয়েছে। আমার কথাগুলোর সরাসরি স্বাক্ষী অথবা প্রমাণ দেখাতে না পারলেও জেলখানার হিস্ট্রি কার্ড (কেইস কার্ড) দেখলে অন্ততঃ দেখতে পারবেন কত দফা ব্যাথানাশক এন্টিবায়োটিক খেতে হয়েছে। সেই পুরোনো ব্যাথাগুলো শরীরের প্রত্যেকটা রগে রগে আবার দেখা দিয়েছে। আল্লাহর কাছে একটাই ফরিয়াদ, আমি জীবিত থাকলে এই পুলিশগুলোর বিচার না হলেও মারা যাওয়ার পর যেন বিচার হয, শ্রেষ্ঠ বিচারপ্রতি ঠিকই বিচার করবেন। আমিন।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানিয়েছেন, সাংবাদিক মোজাহিদের দেওয়া নির্যাতনের বর্ণনা ফেসবুকে পোস্ট করার পর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য পরিদর্শক আফজালকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

এছাড়াও তার বিরুদ্ধে অবৈধ গ্যাস ব্যবসায়ীদের সাথে সখ্যতার একটি অডিয়ো ডিবিসি নিউজে প্রচার করা হয়েছে। একাধিক অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তার নামে। তার নেতৃত্বে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি ছাড়া হয়েছিল কিছুদিন আগেই । দৈনিক যোগফল এ সংক্রান্ত একটি অনুসন্ধানী খবর প্রকাশ করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *