পিয়াজ সংকটের ধকল কাটতে না কাটতেই আবারও পণ্যটি নিয়ে কারসাজি শুরু হয়েছে। ফলে ফের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে পিয়াজের বাজার। সকাল-বিকাল বাড়ানো হচ্ছে রান্নার অতি প্রয়োজনীয় পণ্যটির দাম। রাজধানীর বাজারগুলোতে যে যেভাবে পারছে পিয়াজের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ঢাকার বাজারে পিয়াজে দাম কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে ৭০ টাকায় উঠেছে। হুট করে এমন দাম বাড়ায় বাড়তি পিয়াজ কিনে মজুত করেছেন অনেকেই। বিপাকে পড়েছেন ক্রেতারা।
দেশে পিয়াজের হঠাৎ করে মূল্যবৃদ্ধির পেছনে ভারতের বাজারে পণ্যটির দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে আমদানির চেয়ে বিক্রিতে পিয়াজের মূল্য বেশি রাখায় রোববার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে বেশ কয়েকটি পিয়াজ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছিলেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারতে পিয়াজের দাম বৃদ্ধির খবরে দেশেও পিয়াজের দামে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
এ ছাড়া দেশের মাওয়া ঘাটে ফেরি পারাপার বন্ধ থাকার অজুহাতে ব্যবসায়ীরা পিয়াজের দাম বাড়াচ্ছেন। পাশাপাশি সিন্ডিকেটকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় কারসাজি করে দাম বাড়াচ্ছে তারা। এতে ভোক্তাদের ওপর চাপ বাড়ছে।
জানা গেছে, হঠাৎ করে ২০১৯ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর ভারত সরকার বাংলাদেশে পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এতে দেশের বাজারে দফায় দফায় বাড়তে থাকে দাম। প্রতিদিন এলাকাভেদে পিয়াজের দাম কেজিতে বাড়ে ৫০-৬০ টাকা। এভাবে দাম বাড়তে বাড়তে প্রতিকেজি পিয়াজের মূল্য ২৬০ টাকা পর্যন্ত ওঠে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেশের বিভিন্ন বাজারে অভিযান চালিয়ে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের জরিমানা করে। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে পাকিস্তান, চীন, মিশর, মিয়ানমার, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির সুযোগ করে দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়। সে সময় বিমানে যাত্রীর বদলে পিয়াজ আনা হয়। এ কারণেই অজানা শঙ্কায় ক্রেতারা বাড়তি পিয়াজ কিনেছেন। ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন আভাসই পাওয়া গেছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তৈরি দৈনন্দিন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে দেশি পিয়াজের দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত। গত সপ্তাহে যে পিয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা, এই সপ্তাহে সেই পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে পিয়াজের দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশ। এক মাস আগেই দেশের বাজারে দেশি পিয়াজের কেজি ৪০ টাকার মধ্যে ছিল। আর ভারতীয় পিয়াজের কেজি ছিল ২৫ থেকে ৩০ টাকা।
কাওরান বাজারে পাইকারি দোকানে চার ধরনের দেশি পিয়াজ রয়েছে। রাজশাহী ও পাবনার দেশি পিয়াজের দাম ৬২ থেকে ৬৪ টাকা কেজি। ফরিদপুরের দেশি জাতের পিয়াজের কেজি ৫৬ থেকে ৫৮ টাকা। কিং নামের একটি জাতের দেশি পিয়াজের কেজি ৫৪ থেকে ৫৬ টাকা। আর ভারতীয় বড় পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪৬ টাকা কেজি। অন্যদিকে খুচরা বাজারে এ সব পিয়াজ প্রতিকেজি ৭০ টাকার উপরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
গতকাল কাওরান বাজারের পাইকারি দোকান থেকে উত্তর বাড্ডার বাসিন্দা নাজমা আক্তার ৬০ টাকা দরে ৫ কেজি পিয়াজ কেনেন। তিনি বলেন, সাধারণত দুই কেজি করে কিনি। কিন্তু গত বছরের মতো আবার দাম বেড়ে ৩০০ টাকা পার হয়ে যায় কি না, সেই ভয়ে বেশি করে পিয়াজ কিনলাম।
বিক্রেতা আল আমীন বলেন, আমরা পাইকারিতে যে দরে কিনি, তার সঙ্গে ৪/৫ টাকা লাভ যোগ করে খুচরা বিক্রি করি। কাওরান বাজার থেকে পিয়াজ কিনেছি ৫৪ টাকা দরে, তাই সেটা ৬০ টাকা দরে বিক্রি করছি।
পিয়াজ আমদানিকারক মোবারক হোসেন বলেন, প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারতের বেঙ্গালুরু থেকে নতুন পিয়াজ দেশে আমদানি করা হয়। কিন্তু এ বছর সেখানে অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে পিয়াজের আবাদ মার খেয়েছে। ফলে বেঙ্গালুরুর সেই নতুন পিয়াজটা এবার আসবে না। মূলত এ কারণে পিয়াজের দাম বেড়ে গেছে।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পিয়াজের সংকট নেই। পাবনা, নওগাঁ, রংপুর, বগুড়া, ফরিদপুর, যশোরে গত বছর ভালো দাম পাওয়ায় অনেকেই পিয়াজ আবাদ করেছেন। মূলত সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা আমদানি বন্ধের অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, করোনার কারণে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের আয় কমে গেছে। অথচ এখন বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের কষ্ট বেড়ে যাচ্ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যাতে বাড়ে সেদিকে সরকারের নজর দেয়া উচিত।
সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে বর্তমানে ২৩ লাখ টন পিয়াজ উৎপাদন হয়। কিন্তু পিয়াজ ঘরে তোলার সময় প্রায় ৫ লাখ টন নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ ১৯ লাখ টন পিয়াজ বাজারে থাকে। অন্যদিকে বিদেশ থেকে আমদানি হয় ১১ লাখ টন। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩০ লাখ টন পিয়াজ প্রয়োজন।