ঢাকা: দীপক মল্লিক। বয়স ৪১ বছর। পেশায় চিকিৎসক। প্রথমে তার করোনা শনাক্ত হয় ২০শে এপ্রিল। এ সময় করোনার সব উপসর্গই তার মধ্যে ছিল। সরকারি ল্যাবেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। সুস্থ হওয়ার পরেও ইচ্ছাকৃতভাবে চারবার পরীক্ষা করান তিনি। এতে ফলাফল নেগেটিভ আসে।
কিন্তু আগস্ট মাসের ২৬ তারিখে চার মাস ৯ দিনের মাথায় তিনি আবারও করোনা পজিটিভ হন। অর্থাৎ দ্বিতীয়বার তিনি করোনা শনাক্ত হলেন। তবে এবার করোনার কোনো উপসর্গ ছিল না। শুধু শরীরে ব্যথা অনুভব করেন এই চিকিৎসক। তার স্ত্রীর করোনার উপসর্গ থাকায় তার সঙ্গে তিনিও পরীক্ষা করান। তার স্ত্রীরও পজিটিভ আসে। এই দম্পতির তিন কন্যা সন্তান থাকলেও তারা সামান্য জ্বরেই সেরে উঠেছে। সন্তানদের কোনো টেস্ট করাননি তারা। এই দম্পতি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে সরকারি ল্যাবে টেস্ট করান বলে জানিয়েছেন ডেন্টিস্ট দীপক মল্লিক। তিনি মানবজমিনকে বলেন, দ্বিতীয়বার করোনা আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি তিনি বুঝতেই পারেননি। তবে তার ধারণা দ্বিতীয়বার এক করোনা রোগী দেখতে গিয়ে তিনি আক্রান্ত হয়েছেন। ওই রোগী তার বন্ধুর মেয়ে। তাকে দু’বার দেখতে যান বলে তিনি উল্লেখ করেন। এতে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার চান্সটা বেশি বলে এই চিকিৎসক মনে করেন। ডা. দীপক মল্লিক আরো জানান, রোগীকে দেখতে যাওয়ার ৫ থেকে ৬ দিনের মাথায় তার দ্বিতীয়বার পজিটিভ আসলো। প্রথমবার শনাক্ত হওয়ার পর ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে ছিলেন, এবারও আছেন।
আরেক দ্বিতীয়বার আক্রান্ত রোগী ডা. মুহাম্মাদ শিহাব উদ্দিন। ১লা জুন বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা করা হলে এই চিকিৎসকের শরীরে দ্বিতীয়বারের মতো করোনা পজিটিভ আসে। আক্রান্ত চিকিৎসক শিহাব উদ্দিন বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সের মেডিকেল অফিসার। ডা. শিহাব উদ্দিন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, গত এপ্রিল মাসের জেনারেল ওয়ার্ডে মারামারি করে ভর্তি হওয়া এক রোগী এবং হাসপাতালের একজন নার্স, একজন পিয়নের শরীরে করোনা পজিটিভ আসে। এ খবর শোনার পরে হাসপাতাল লকডাউন ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে তিনি হোম আইসোলেশন চলে যান। ১৮ই এপ্রিল তার নমুনা নেয়া হলে ২০শে এপ্রিল রিপোর্টে তিনি জানতে পারেন তিনি করোনা আক্রান্ত। ২৩শে এপ্রিল ডা. শিহাব বরিশাল শেরে-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটের ভর্তি হয়ে চিকিৎসা শেষে ২৭শে এপ্রিল সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরেন। পরবর্তীতে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে শেষে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গত ২০শে মে পুনরায় কর্মস্থলে যোগদান করেন তিনি। ২৬শে মে একজনকে বাঁচাতে প্লাজমা দেয়ার জন্য তিনি ঢাকায় যান। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে প্লাজমা দিয়ে ওইদিন রাতেই বরিশালে ফিরে আসেন। ঢাকা থেকে কর্মস্থলে ফেরার পর থেকে জ্বর-সর্দি-কাশি অর্থাৎ শরীরে করোনার উপসর্গ অনুভব করায় ৩০শে মে পরীক্ষার জন্য নমুনা দেন। পহেলা জুন আবার রিপোর্ট পজিটিভ আসে। রাজধানীর সরকারি চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের খাদিজা নামের এক সিনিয়র নার্সও দ্বিতীয়বার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন তারই এক সহকর্মী।
শুধু দীপক বা শিহাব উদ্দিন নন, দেশে দ্বিতীয় বার আক্রান্ত হওয়ার খবর আসছে। করোনা রোগী সেরে গেলেও পর্যবেক্ষণে রাখা প্রয়োজন। ফল নেগেটিভ এলেও বহু দিন সতর্কতা মেনে চলতে হবে। চীনে সুস্থ হওয়া রোগীদের মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশের শরীরে নতুন করে রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় দুই শতাধিক মানুষ নতুন করে আক্রান্ত। খবর এসেছে জাপান, ইরান থেকেও।
গত ২৬শে আগস্ট এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম জানিয়েছেন, একবার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়ার পর দ্বিতীয়বার আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। ডা. খুরশীদ আলম বলেন, বাংলাদেশে সেকেন্ড ইনফেকশন বা দ্বিতীয়বার সংক্রমণ হয়েছে এমন লোকের সংখ্যা কম না। যদিও এ মুহূর্তে সে সংখ্যাটা কতজন সেটা দিতে পারবো না, কিন্তু আমি আমার পরিচিত অন্তত ১৫ থেকে ২০ জনের মতো জানি যাদের দ্বিতীয়বার ইনফেকশন হয়েছে। প্রথমবার ইনফেকশন হয়ে ভালো হয়ে গিয়েছেন, এক থেকে দেড় মাস পার করেছেন। দ্বিতীয়বার আবার হওয়ার পর পরীক্ষা করে পজিটিভ এসেছে।
এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, দ্বিতীয়বার সংক্রমণ হওয়ার তথ্য আছে। গবেষণা করে নিশ্চিত হওয়া দরকার। যারা আক্রান্ত হয়েছিলেন তারা কি পুরোপুরি সুস্থ হয়েছিলেন। নাকি রোগীটি রিল্যান্স করেছে। যাদের দ্বিতীয়বার করোনা হয়েছে- তাদের সঠিক তথ্য নেয়া দরকার। মনিটরিং করতে হবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে।
এ বিষয়ে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য, দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাসে দ্বিতীয়বার আক্রান্তর খবর আসছে। এজন্য বিশ্লেষণ দরকার, গবেষণা দরকার। একটি লোক ভালো হওয়ার পর কেন দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছে। শরীরে পুষ্টি এবং ইমুউনিটি ঘাটতির কারণেও হতে পারে।
এ বিষয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, অ্যান্টিবডি তৈরি না হলে দ্বিতীবার আক্রান্ত হতে পারেন। এটা শুরু থেকেই হয়ে আসছে।