ভয়ঙ্কর স্মৃতি এখনো চোখে ভাসে তাদের

Slider জাতীয়


একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বর এক ঘটনা। ২০০৪ সালের এইদিনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের রক্তে ভেসে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এলাকা। হামলায় ২৪ নেতাকর্মীর জীবন প্রদীপ নিভে যায়। আহত হন কয়েক শ’ নেতাকর্মী। যাদের অনেকেই এখনো হামলার ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন। ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যাওয়া নেতাকর্মীদের চোখে এখনো সেই দিনের দৃশ্য ভাসে। এই দিনের ঘটনায় অন্যদের মতো আহত হয়েছিলেন অ্যাডভোকেট উম্মে রাজিয়া কাজল, সাবেক সংসদ সদস্য নাসিমা ফেরদৌস এবং মাহবুবা পারভীন। ভালো নেই তারা।
শতাধিক স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা এবং আঘাতের কারণে তাদের কাছে ৩৬৫ দিনই ২১শে আগস্টের মতো। মানবজমিনের সঙ্গে কথা হয় তাদের। ২১শে আগস্টের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। অ্যাডভোকেট উম্মে রাজিয়া কাজল বলেন, ‘ভালো নেই। এত যন্ত্রণা আর কষ্ট নিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকি। দিন যত গড়াচ্ছে শরীরের যন্ত্রণা তত প্রকট হচ্ছে। ব্যথা অনেক বেড়ে গেছে। এরচেয়ে মৃত্যু মনে হয় ভালো ছিল। ব্যথার যন্ত্রণায় দু’পা হাঁটু পর্যন্ত ধরে যায়। কি করবো বুঝতে পারছি না। প্রচুর ব্যথা। যন্ত্রণায় পাগল হয়ে যাই। স্বেচ্ছাসেবক লীগের এই নেত্রী বলেন, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মনিপুরিপাড়ার ভাড়া বাসায় থাকি। একদিনের জন্যও এই কলঙ্কজনক দিনটির কথা ভুলিনি।

ভুলে থাকা যায় না। কারণ শরীরের মধ্যে যে স্প্লিন্টার বিদ্ধ আছে তাতে যে যন্ত্রণা মনে হয় ২৪ ঘণ্টাই যন্ত্রণার মধ্যে থাকি। ব্যথার ওষুধ খেলে সাময়িকভাবে উপশম বোধ করলেও পরক্ষণে বেড়ে যায়। কত ওষুধ খাওয়া যায়। দু’পায়ের পাতা থেকে হাঁটু পর্যন্ত মনে হয় কাঁটা বিদ্ধ। নিচু হয়ে কোথাও বসতে পারি না। ওই দিনের ঘটনায় আহত অনেকেই মারা গেছেন। কিন্তু আমরা বেঁচে আছি অন্যের ওপর নির্ভর করে। অন্য কেউ বুঝতে পারবে না কতোটা ভয়াবহ যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছি। এ ঘটনায় আহত নারী নেত্রী মাহবুবা পারভীন বলেন, দুই ছেলেকে নিয়ে সাভারে আছি। আমি ভালো নেই। খুব খারাপ অবস্থায় আছি। গত মঙ্গলবার রাত তিনটায় আমার শরীরের যন্ত্রণা এবং চিৎকারে এলাকার লোকজন ছুটে আসে। আমাকে সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের একমাত্র চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকেন্দ্র ‘সিআরপি’তে ভর্তি করা হয়।

গ্রেনেড হামলায় মারাত্মকভাবে আহত এবং হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর শরীরের বাম অংশটি পুরোটা প্যারালাইজড হয়ে যায়। ডান পা এবং হাত এতদিন ভালো ছিল। এখন ডান পা ধরে গেছে। ২১শে আগস্ট আমি উপুর হয়ে পড়ে গেলে শরীরের উপর দিয়ে নেতাকর্মীরা প্রাণ বাঁচাতে প্রাণপণ ছুটতে থাকে। আমার পিঠের উপর দিয়ে তাদের দৌড়ানোর কারণে পিঠের মাংস থেঁতলে যায়। ডান হাঁটুতে চোট লাগে। হাঁটুর অবস্থা খুব খারাপ এখন। রাতে ঘুমাতে পারি না। চিকিৎসক জানিয়েছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শরীরে থেরাপি দিতে হবে। থেরাপি বন্ধ করলে বিছানায় পড়ে যাবো। গ্রেনেড হামলায় শরীর থেকে প্রায় চার ব্যাগ রক্ত বেরিয়ে যায়। কিছু মনে রাখতে পারি না। ভুলে যাই। দুই ছেলে তখন বিএফ শাহীনের শিক্ষার্থী ছিল। এক নারী নেত্রীর ফোন পেয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সমাবেশে চলে যাই। নেত্রীকে খুব কাছ থেকে দেখবো বলে সেদিন মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। নেত্রী (শেখ হাসিনা) ‘জয় বাংলা’ বলে ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলার সুযোগ পায় নি। এর মধ্যে সব শেষ। দাঁড়ানো অবস্থায়ই আমার শরীর থেকে বাম পা এবং হাত ছিটকে পড়ে বলে মনে হয়েছিল। তখন মনে হচ্ছিল শেষবারের মতো যদি সন্তান দুটোর মুখ দেখতে পারতাম!

আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা হাসপাতালে নিয়ে গেলে দেখি বারান্দা, মেঝে এবং বিছানায় রক্তাক্ত নেতাকর্মী। সবাই চিৎকার করছে- বাঁচাও বলে। আমি মৃতপ্রায় ছিলাম। নড়াচড়া করছি না। চিকিৎসকরা ভেবেছে মারা গেছি। তখন দেশের তিনটি হাসপাতালে আমার চিকিৎসা হয়। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হককে নেত্রী আমার চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব দেন। তিনি নেত্রীকে জানান, মাহবুবাকে কোনোভাবে বাঁচানো সম্ভব নয়। কিন্তু নেত্রীর একটি কথাই ছিল, যেখানে যেভাবে সম্ভব মাহবুবাকে বাঁচাতে হবে। পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসায় ভারতে পাঠানো হয়। পাসপোর্টে স্বাক্ষর পর্যন্ত করতে পারিনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার দুই ছেলের পড়ালেখা এবং আমার যাবতীয় চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন।

নাসিমা ফেরদৌস বলেন, বর্তমানে পরিবার নিয়ে উত্তরাতে থাকি। আসলে আমি তো ওই দিন ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাই। লাশের ট্রাকে ছিলাম। আমাকে মৃত ভেবে লাশের ট্রাকে তোলা হয়। তখন আমার শরীরের প্রায় দেড় হাজারের মতো স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়। নেত্রীর ওপরে যে গ্রেনেডগুলো মারা হয় সেগুলো আমাদের ওপর পড়ে। আইভি আপা আমার ডান পাশে ছিলেন। আপা দুমড়ে মুচড়ে যান। আমিও পড়ে যাই। আমার চেয়ে আপা বেশি আহত হয়েছেন সেটা দেখতে পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল তাকে ধরবো। কিন্তু ধরার মতো শক্তি ছিল না। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল হয়ে দিল্লির এ্যাপোলো হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা চলে। এরপর বিদেশে। প্রায় ২৪ থেকে ২৫টি বড় ধরনের অপারেশন হয়েছে। শরীরে দেড় হাজার স্প্লিন্টার বহন করে জোড়াতালি দেয়া একেবারে চূর্ণবিচূর্ণ এবং ক্ষতবিক্ষত এই আমি। এখনো সুস্থ একজন মানুষ আমার পা দুটো দেখলে শিউরে উঠবে। ২১শে আগস্টে একটি কথাই বলবো, আমরা যারা আহত হয়ে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করছি আমাদের তো কোনো অপরাধ ছিল না। মরেও বেঁচে আছি। আমাদের অপরাধ একটিই ছিল আওয়ামী লীগ করি। এই ধরনের বর্বর হামলা আর যেন কোনো ব্যক্তি, মানুষ এবং সংগঠনের ওপর না আসে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *