ঢাকা: দেশে করোনা সংক্রমণ কমার কোনো লক্ষণ নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাকসিন আসার আগ পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিতে হবে। আর দ্বিতীয় বিকল্পটি হলো ভ্যাকসিন। এই ভ্যাকসিন পাওয়ার দৌড়ে এখন বিশ্বের দেশগুলো। দেশে দেশে ভ্যাকসিন তৈরির প্রতিযোগিতা। সমালোচনা থাকলেও প্রথম ভ্যাকসিন আবিষ্কার এবং তা প্রয়োগের ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও চীনের তৈরি ভ্যাকসিন এখন পর্যন্ত এগিয়ে রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই ভ্যাকসিন পেতে আগাম চুক্তি করে রেখেছে।
এই অবস্থায় বাংলাদেশ এখনো গন্তব্যহীন। বাজারে আসলে কোথা থেকে করোনা ভ্যাকসিন নেয়া হবে এ নিয়ে কোনো সরকারি সিদ্ধান্ত নেই। স্বাস্থ্যমন্ত্রী গতকাল জানিয়েছেন আগামী সপ্তাহে এ নিয়ে বৈঠকের কথা। আর অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, ভ্যাকসিনের জন্য অর্থ বরাদ্দ রয়েছে। যেকোনো উৎস থেকে হলেও এই ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে হবে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনো গন্তব্য ঠিক না হওয়ায় বাজারে আসলেও ভ্যাকসিন পেতে বেগ পেতে হবে বাংলাদেশকে। কারণ আগে চুক্তি করা দেশগুলোকেই আগে ভ্যাকসিন সরবরাহ করবে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। তাই দেরি হলেও এখনই এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন তারা। সর্বশেষ রাশিয়া যে ভ্যাকসিন বাজারে আনার ঘোষণা দিয়েছে তারও বুকিং দিয়ে রেখেছে অনেক দেশ। তবে এই ভ্যাকসিন নিয়ে বাংলাদেশের তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সরকারের তরফে বলা হচ্ছে এই ভ্যাকসিন যেহেতু এখনো পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে তাই ভবিষ্যৎ দেখেই এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হবে।
চীনের ভ্যাকসিনটি এদেশে ট্রায়ালের কথা থাকলেও এটা এখন অনিশ্চিত। দেশটির সিনোভ্যাক কোম্পানির ভ্যাকসিনের ট্রায়াল বাংলাদেশে হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতো। ভ্যাকসিন নিয়ে পরামর্শক কমিটিতে কোনো আলোচনাও হয়নি বলে জানান কমিটির অন্যতম এক সদস্য। সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন অতি দ্রুত ভ্যাকসিনের পেছনে ছোটা। ভ্যাকসিন তৈরির পরপরই যেন বাংলাদেশ তা হাতে পায়, সেজন্য এখন থেকেই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়া।
রাশিয়ার ভ্যাকসিন আবিষ্কারের খবরে বাংলাদেশেও এক ধরনের উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা না পেরুতেই তাদের ভ্যাকসিন নিয়ে বিশ্বের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা প্রশ্ন তুলেছেন। মানবদেহে প্রয়োগের দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে রাশিয়া করোনার যে ভ্যাকসিনটি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দিয়েছে, তা নিয়ে সতর্ক করে প্রশ্ন তুলেছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, ট্রায়ালের সম্পূর্ণ তথ্য ছাড়াই ভ্যাকসিনটির সুরক্ষা ও কার্যকারিতার ব্যাপারটি বিশ্বাস করা কঠিন। আর এরপর থেকেই বাংলাদেশে রাশিয়ার ভ্যাকসিন নিয়ে ভাটা দেখা দিয়েছে।
এদিকে, গতকাল সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, বাংলাদেশের ভ্যাকসিন কেনার বিষয়ে আগামী সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনলাইনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকের শেষদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরো বলেন, আগামী সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের মিটিং সেট করা হয়েছে। সেই মিটিংয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো যে চীনকে বাংলাদেশে তাদের ভ্যাকসিন ট্রায়াল করতে দেয়া হবে কিনা। এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হলে চীন বাংলাদেশে কতো মানুষের ওপর ট্রায়াল করবে, এক্ষেত্রে চীন আমাদের কতো টাকা দেবে, ট্রায়াল হলে চীন কি শর্তে ভ্যাকসিন দেবে- সেসব নিয়ে সিদ্ধান্তের পর চীনকে ট্রায়াল করতে দেয়া হবে। তিনি বলেন, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় যে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করছে তা বিভিন্ন দেশে সরবরাহ করার জন্য তারা চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে এবং অ্যাডভান্স নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মর্ডানাসহ অন্য ভ্যাকসিন উদ্ভাবক কোম্পানিগুলোর সঙ্গেও বিভিন্ন দেশ চুক্তি করছে এবং অ্যাডভান্স দিচ্ছে। যারা আগে থেকে অ্যাডভান্স করে রাখছে, তাদের আগে টিকা সরবরাহ করবে কোম্পানিগুলো। আমরাও এসব কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করা কিংবা অ্যাডভান্স দেয়ার বিষয়েও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা টিকা উদ্ভাবক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। সংস্থাটির লক্ষ্য হলো শুরুতে বিভিন্ন দেশের ৩ শতাংশ মানুষকে টিকা সরবরাহ করা এবং আগামী মার্চে তারা ২০ শতাংশ মানুষের জন্য টিকা সরবরাহের উদ্দেশ্যে কাজ করছে।
বৈঠক শেষে ভার্চ্যুয়াল ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যে সোর্সের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দ্রুত পাওয়া যাবে তাদের সঙ্গেই যোগাযোগ করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসের টিকা আমরা কীভাবে সংগ্রহ করবো এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তবে কীভাবে টিকা সংগ্রহ করা হবে সে বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমরা পাইনি। আমার পক্ষে এ বিষয়ে চূড়ান্তভাবে কোনো কিছু বলা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বলেছি টিকা সংগ্রহের জন্য একটি সোর্সের ওপর নির্ভর করলে এটা পাওয়া কঠিন হবে। আমি এরই মধ্যে দেখেছি যেসব দেশ ভ্যাকসিন তৈরি করবে তাদের সঙ্গে অনেক দেশ চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, অগ্রিম টাকাও দিয়েছে। আমি স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বললাম আমাদেরও এ ধরনের ব্যবস্থায় যেতে হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, টিকা সরবরাহের জন্য অক্সফোর্ড ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশে যোগাযোগ করেছে। আমরা যদি সরাসরি অক্সফোর্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে নাও পারি, তাহলে অন্তত ভারত সরকারের সঙ্গে আমরা সম্পৃক্ত হতে পারি। আসল কথা হচ্ছে, আমাদের পিছিয়ে থাকলে হবে না। সব সোর্সের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। যেখান থেকে আমরা টিকা পাবো সেখান থেকে নিতে হবে। তিনি বলেন, রাশিয়া ইতিমধ্যে তাদের টিকা প্রয়োগ করেছে। আমার মনে হয় রাশিয়ার টিকা দ্রুত বাজারে আসবে। রাশিয়া থেকে টিকা পাওয়ার জন্য তাদের সোর্সের সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ করতে হবে। যারাই টিকা তৈরি করে তাদের সঙ্গেই আমাদের যোগাযোগ করতে হবে। টিকা কেনার জন্য বাজেটে কিছু অর্থও বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যাতে ভ্যাকসিন কেনা বা আগে পাওয়ার জন্য আমরা জরুরি প্রয়োজনে অর্থায়ন করতে পারি।
রাশিয়া ভ্যাকসিন প্রয়োগ করেছে এবং তাদের ভ্যাকসিন আনার কোনো উদ্যোগ আছে কিনা জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মানান মানবজমিনকে বলেন, রাশিয়া তাদের ভ্যাকসিন এখন টেস্ট করাচ্ছে। এ জন্য তারা একটি সময় নেবে। আমরা ভ্যাকসিনের বিষয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। যাদের ভ্যাকসিন ট্রায়াল হচ্ছে। দেখা যাক।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক এ ব্যাপারে মানবজমিনকে বলেন, ভ্যাকসিন বিষয়ে ডব্লিউএইচও’র গাইড লাইন ও ক্রাইটেরিয়া আছে। তা পূরণ করতে হবে। পৃথিবীর মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। মানবদেহের ক্ষতিকর নয়, সহায়ক। ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে এই দুইটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, ভ্যাকসিন আবিষ্কারে কয়েকটি দেশ এগিয়ে রয়েছে। এর মধ্যে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন, চীনের ভ্যাকসিন এবং রাশিয়ার ভ্যাকসিন মানবদেহে প্রয়োগের তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে। অক্সফোর্ড ও চীনের ভ্যাকসিন অনেক দেশ অংশ গ্রহণ করেছে। রাশিয়ার ভ্যাকসিনে করেনি। রাশিয়া তা প্রকাশও করেনি। রাশিয়ার দ্বিতীয় পর্যায়ে কত সময় নিয়েছে-তা ডব্লিউএইচও’র মনিটরে নেই। তিনি আরো বলেন, ভ্যাকসিন ট্রায়ালে যেসব দেশ অংশগ্রহণ করছে তারা অগ্রাধিকার পাবে। বাংলাদেশ গবেষণায় অংশগ্রহণ করেনি। বিল গেটস এর গ্যাভী ফাউন্ডেশনের ভ্যাকসিন পেতে আগ্রহ দেখিয়ে আবেদন করেছে বলে উল্লেখ করেন এই বিশেষজ্ঞ। চুক্তি বা কিনার জন্য কোন কিছুই করেনি বাংলাদেশ। ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্যর অধিদপ্তরের ডিজি বলছেন গ্যাভীর সঙ্গে চুক্তি হয়েছে-এমন প্রসঙ্গে তুলে অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, কে ওই চুক্তিতে সই করেছেন। তা জনগণকে জানাতে হবে। বাংলাদেশ চীনের সিনোভ্যাক কোম্পানির ভ্যাকসিন ট্রায়ালে অংশীদারিত্ব হলে সুবিধা পেতো। অগ্রাধিকার থাকতো। কিন্তু এটা অনিশ্চিত দেখছি। বাংলাদেশ ভ্যাকসিন দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।