বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের টানা অবরোধে দেশজুড়ে আতঙ্কের নাম এখন পেট্রলবোমা। এই বোমা মানুষের জীবন ও জীবিকাকে ভয়াবহ করে তুলছে। অতীতেও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সহিংসতা হয়েছে। কিন্তু এবার নিরীহ মানুষের চলাচলের বাসে পেট্রলবোমা হামলার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি অবর্ণনীয় হয়ে উঠেছে।
জানা গেছে, হামলা এবং যানবাহনে অগি্নসংযোগসহ বিভিন্ন ধরনের নাশকতায় এ পর্যন্ত ২৯ জন নিহত হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে নাশকতা বা সহিংসতার বিষয়ে ব্যাপক সমালোচনা উঠেছে। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং আন্দোলনকারী বিএনপি_ দু’পক্ষই সহিংসতার জন্য একে অপরকে দায়ী করছে।
এ ব্যাপারে সিনিয়র সাংবাদিক আমানউল্লাহ কবির বিবিসিকে বলেন, এ ধরনের সহিংসতা ঘটানোর কাজ যদি বিএনপি কৌশল হিসেবেও নেয়, সেটা জনগণ গ্রহণ করবে না। কারণ, এতে নিরীহ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকার এবং আন্দোলনকারীরা_ দু’পক্ষই অনড় অবস্থান নেয়ায় পরিস্থিতি বেশি খারাপ হচ্ছে। সরকারের দিক থেকে অসংযত কথাবার্তা এবং উস্কানিমূলক বক্তব্য আন্দোলনকারীদের আরো উস্কে দিচ্ছে।
আমানউল্লাহ কবির মনে করেন, সহিংসতা দীর্ঘস্থায়ী হলে পরিস্থিতি সরকার এবং আন্দোলনকারী_ দু’পক্ষেরই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। সেটা আরো খারাপ অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে।
এ কারণেই রাজধানীতে তৎপর অর্ধশত পেট্রলবোমাবাজের তালিকা নিয়ে মাঠে নেমেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) বিশেষ টিম। ইতোমধ্যে হামলাকারী এবং হামলায় সমন্বয়কারী হিসেবে চিহ্নিত ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া জানান, নিরীহ জনগণের ওপর পেট্রলবোমা হামলাকারী এবং নাশকতাকারীদের গ্রেপ্তারে পুলিশ ও গোয়েন্দারা কাজ শুরু করেছে। একদিকে বোমাবাজদের তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে, অপরদিকে এই তালিকা অনুযায়ী গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হচ্ছে। যারা বোমা মারছে এবং এই জঘন্য কাজে অর্থের জোগান দিচ্ছে, তাদেরও গ্রেপ্তার করা হবে।
এদিকে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার পর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক পেট্রলবোমা হামলার ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানও হামলা থেকে রেহাই পাননি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে জোটের নেতাকর্মীরা রাজপথে নামতে পারেনি। কিন্তু এক পর্যায়ে তারা চোরাগোপ্তা হামলা শুরু হয়। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের বাসভবন এবং যাত্রীবাহী যানবাহন হামলাকারীদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়। যানবাহনে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধদের চিত্র দেখে সবার টনক নড়ে। এ অবস্থায় বোমা হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে বিশেষ টিম গঠন করে অভিযান শুরু করা হয়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি জাহাঙ্গীর হোসেন মাতবর জানান, নাশকতা চালানোর ঘটনায় ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। তারা সবাই পেশাদার বোমাবাজ। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া নাশকতামূলক ঘটনার সঙ্গে তাদের প্রত্যেকের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা টাকার বিনিময়ে নাশকতা চালায়। ভিআইপিদের বাসাবাড়ি ও যানবাহনে ককটেল এবং পেট্রলবোমা হামলা চালায়।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শাহবাগ, তোপখানা রোড, প্রেসক্লাব, পুরানা পল্টন এবং মৎস্য ভবন এলাকার তালিকাভুক্ত বোমাবাজ ইকবাল হোসেন ওরফে রানাকে (৩২) পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তার বাবার নাম জয়নাল আবেদীন। ৩৭ নাম্বার তোপখানা রোডে তার বাসা। রানার নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট হরতাল-অবরোধ চলাকালে শাহবাগ ও পল্টন থানা এলাকায় পেট্রলবোমা হামলা চালিয়ে আসছে। রানা গ্রেপ্তারের পর তার সহযোগীরা গা-ঢাকা দিয়েছে।
মমিনুল ইসলাম মনির ওরফে বোমা মনির (৩২) নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে রাজধানী পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলার ঘটনায় জড়িত। বোমা হামলায় দক্ষতার কারণেই এলাকায় তার নাম বোমা মনির। পুলিশ অনেকদিন ধরেই তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। সম্প্রতি গোয়েন্দা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। বোমা মনিরের বাবার নাম মৃত আ. খালেক ক্কারী। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার খোদনাইল চৌধুরীপাড়ায় তার বাসা। তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া থানার ৯ নাম্বার লতাচাপলি ইউনিয়নে।
আলাউদ্দিন চৌধুরী ওরফে বোমা বাবু (৩০) খিলগাঁও থানা এলাকার বাসিন্দা। বহুদিন ধরেই একটি রাজনৈতিক দলের ক্যাডার হিসেবে পেট্রলবোমা হামলাসহ বিভিন্ন ধরনের নাশকতামূলক কর্মকা- চালিয়ে আসছে। খিলগাঁও এবং রামপুরা এলাকায় সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর কাছে বোমা বাবু হিসেবেই সে পরিচিত। খিলগাঁও এবং রামপুরা থানা এলাকায় তার নেতৃত্বেই বিভিন্ন সময় বোমা হামলা চালানো হয়েছে। তার বাবার নাম মৃত নূরনবী চৌধুরী। খিলগাঁও থানাধীন ১৯৮/১ নাম্বার পূর্ব গোরানে তার বাসা। নোয়াখালী জেলার মাইজদী থানার ধন্যপুরে তার গ্রামের বাড়ি।
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এবং পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকার চিহ্নিত বোমাবাজ হিসেবে পরিচিত কায়সার আহম্মেদ সোহেল ওরফে বোমা সোহেল (৩০)। বোমা সোহেল কামরাঙ্গীরচর এবং লালবাগ এলাকায় অবরোধ চলাকালে বিভিন্ন সময় যানবাহনে পেট্রল ঢেলে অগি্নসংযোগ করেছে এবং পেট্রলবোমা হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। তার বাবার নাম দেলোয়ার হোসেন। কামরাঙ্গীরচর থানাধীন আগ্রাবাদ এলাকায় তার বাসা।
কামরাঙ্গীরচর এলাকার অপর এক বোমাবাজ আ. মালেক ওরফে বোমা মানিককে (৩১) গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। বোমা সোহেল ও বোমা মানিক একত্রে বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে। তার বাবার নাম ইদ্রিস মিয়া। নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী থানার বদরপুরে তার গ্রামের বাড়ি।
রাজধানীর বংশাল এলাকায় একাধিক বোমাবাজের নাম গোয়েন্দাদের তালিকায় রয়েছে। তারা সংগঠিতভাবে বংশাল, গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, বঙ্গবাজার, চানখাঁরপুল এবং জিপিও এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা চালায়। তাদের মধ্যে আব্দুর রহমান ওরফে রহমান ওরফে বোমা রহমান (৩৮) অন্যতম। তার বাবার নাম মৃত আ. কাদের। বংশাল থানাধীন চুড়িওয়ালা গলির ১১৭ নাম্বার বাড়ির বাসিন্দা সে। বংশাল এলাকার চিহ্নিত বোমাবাজ উজ্জ্বল হোসেনকেও (২৬) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বাবার নাম মৃত মোহন মিয়া। বংশাল থানাধীন ৩৯/১ নাম্বার পুরাতন মোগলটুলী এলাকায় তার বাসা। এই এলাকার অপর চিহ্নিত বোমাবাজ সোহেল ওরফে চাঁন সোহেল ওরফে মিলানকে (২৮) সম্প্রতি গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। মিলনের বাবার নাম সোহরাব হোসেন। হাজী আ. সরকার লেনের মাহমুদ পাগলার বাড়িতে থাকে। মিলনের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর থানার ঝিটকায়।
চকবাজারের ফারহান রহমান (১৮) পুরান ঢাকার অন্যতম বোমাবাজ হিসেবে পুলিশের তালিকায় নাম রয়েছে। তার বাবার নাম আসাদুর রহমান। ১৯ নাম্বার আগানব নওয়াব দেউড়ি এলাকায় তার বাসা। মোহাম্মদপুর এলাকার চিহ্নিত বোমাবাজ হারুনুর রশিদকে (২০) পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তার বাবার নাম আহসানউল্লাহ ভূঁইয়া। ১২৩/এ শাহজাহান রোডে তার বাসা। মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, আসাদগেট, কৃষি মার্কেট, আদাবর ও কল্যাণপুর এলাকায় বোমাবাজির অন্যতম নায়ক সে।
এছাড়া চিহ্নিত বোমাবাজ রফিকুল ইসলাম রিপন ওরফে বোমা রিপন (৩৫) এবং মো. রুবেলকে (২৩) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই দুজনই রাজধানীতে ভাসমান অবস্থায় থাকে। তাদের মধ্যে রিপনের বাবার নাম মো. নূরুল ইসলাম। নরসিংদী জেলার বেলাবর ঘাটিয়াপাগায় রিপনের গ্রামের বাড়ি। রুবেলের পিতার নাম মৃত আয়নুল হক। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার নীললক্ষ্মী গ্রামে।
গত মঙ্গলবার রাতে বনানী থেকে গ্রেপ্তারকৃত শিবির নেতা মোস্তাফিজুর রহমানের নামও গোয়েন্দাদের তালিকায় রয়েছে। মহাখালী-বিমানবন্দর সড়ক-বনানী এলাকায় সব বোমাবাজির ঘটনার সঙ্গে মোস্তাফিজের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্র আরো জানায়, পেশাদার আরো ৬ বোমাবাজকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তাদের সবাই বংশাল এলাকার বাসিন্দা। তাদের মধ্যে আছে মোস্ট ওয়ান্টেড বোমাবাজ বংশাল থানাধীন ৩৮ নাম্বার কেরোসিনকাঠ গলির হাবিবুল বাশার ওরফে জহির (৩০)। তার বাবার নাম সিরাজুল ইসলাম। চাঁদপুর সদরের বিষ্ণুপুরে তার গ্রামের বাড়ি। বংশালের ৯/১০ নাম্বার পুরাতন মোগলটুলীর বাসিন্দা মো. পারভেজ (২৭)। তার বাবার নাম শফিউদ্দিন মিয়া। ৮৭/৮৮ নাম্বার হাবিবুল্লাহ সরকার রোডের মো. পাভেল (২৮)। তার বাবার নাম মজিবুর রহমান। ১৬১/২ নাম্বার হাজী ওসমান গনি রোডের বোমাবাজ মো. আরমান (২৮)। তার বাবার নাম আব্দুর রব ওরফে ভুলু মিয়া। ৫৮/২ নাম্বার হাজী আব্দুল্লাহ সরকার লেনের রকিবুল হাসান রকি (৩০)। তার বাবার নাম জমসের আলী। ২২২ নাম্বার বংশাল রোডের বোমাবাজ সোহেল ওরফে চাচা সোহেল (৩৫)। তাদের অধীনে বেশ কিছু সহযোগী রয়েছে। তাদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তারা অনেক সময় ভাড়াটে বোমাবাজ হিসেবেও নাশকতামূলক কর্মকা- চালায়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি মাহফুজুল ইসলাম জানান, বোমাবাজরা ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে রাজনৈতিক দলের নেতাদের বাসভবন, যানবাহন এবং স্থাপনায় পেট্রলবোমা ও ককটেল হামলা চালায়। গোয়েন্দা পুলিশ তাদের চিহ্নিত করার পরই গ্রেপ্তার অভিযান শুরু করেছে। প্রত্যেককে খুঁজে বের করতে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
নাশকতায় যুক্ত ৪৫-৫০ জন
অন্যদিকে, রাজধানীজুড়ে নাশকতার জন্য ৪৫ থেকে ৫০ জনকে শনাক্ত করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। ৮-১০টি দলে ভাগ হয়ে ছোট বোতলে পেট্রল ভরে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা। কারো সঙ্গে থাকছে ককটেল। যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে, সলিতায় আগুন দিয়ে যানবাহনে ছুড়ে দিচ্ছে। তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে কোনো কোনো দল।
ফায়ার সার্ভিসের হিসাব অনুযায়ী, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে গত ১৬ দিনে শুধু ঢাকা এবং এর আশপাশের এলাকায় যানবাহনে পেট্রলবোমা, আগুন, ভাংচুর ও ককটেল হামলার ঘটনা ঘটেছে তিন শতাধিক। এসব ঘটনায় একজন প্রাইভেটকারচালক দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন অন্তত ২৫ জন।
র্যাবের তথ্যমতে, সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলরদের মধ্যে মিরপুরের হাসান, রাজাবাজারের আনোয়ার, শেখেরটেকের মনির, শেওড়াপাড়ার হেলাল, মগবাজারের মজিদ, হাতিরপুলের সিরাজুল ইসলাম, ধানম-ির বাবলু, ওয়ারীর আবুল বাশার, লালবাগের কালা খোকন, কোতোয়ালির মো. মোহন, ডেমরার নবীউল্লাহ নবী এবং এলডিপির যুগ্ম সম্পাদক শাহাদাত হোসেন সেলিম এসব নাশকতাকারীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন। গত শনিবার রাতে রমনায় পুলিশবাসে পেট্রলবোমা হামলার ঘটনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ারসহ ২৭ জনের নাম উল্লেখ করে পুলিশ মামলা করেছে। তার মধ্যে কফিলউদ্দীনসহ ওই ১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।