ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা: করোনা আমাদের স্বাস্থ্য খাতকে সম্পূর্ণই উদোম করে দিয়েছে। দুর্নীতি, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, সমন্বয়হীনতা, প্রতারণা, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জালিয়াতি এই সবই প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়েছে এই সময়। মানুষ মূল্য দিয়েছে জীবন আর জীবিকার বিনিময়ে। করোনা নিয়েও যে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা ফাঁদা যায় সেটা আমরা এইবার বিশ্বকে দেখিয়ে দিলাম। আমাদের ভুয়া করোনা রিপোর্ট শিরোনাম হলো CNN, New York Times, Al jazeera, Guardian এর মতো পত্রিকায়। এই ভুয়া রিপোর্টের কারণে রিজেন্ট হাসপাতাল, জেকেজিসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ধরা হলো, আনা হলো আইনের আওতায়। সরানো হলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বয়ান মতে উপরের নির্দেশেই তারা এই কাজ করেছে।
তারপরও রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বয়ং উপস্থিত থেকেও রয়ে গেলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
আসলেন নতুন মহাপরিচালক। তিনি ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের প্রধান। শিক্ষকতা এবং চিকিৎসা সেবার মতো মহান পেশার সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন জীবনভর। সেখানে নিঃসন্দেহে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। তবে কোনো প্রশাসনিক পদে এটিই তার প্রথম পদচারণা। তাই প্রশাসন চালানোতে তার দক্ষতা, যোগ্যতা, মেধা বা সক্ষমতা দেখবার কোনো সুযোগ আমাদের হয়নি। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নিযুক্ত হবার পরে তার কিছু মন্তব্য অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে। তিনি কাকে সন্তুষ্ট করতে কিংবা কার রোষানল থেকে আগেভাগেই নিজেকে রক্ষা করতে এ ধরনের মন্তব্য করেছেন সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। তিনি যা বলেছেন তা হলো –
‘আমরা যদি ব্যক্তিগতভাবে সৎ না হই তাহলে কোনোভাবেই দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব নয়’। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি বলবো দুর্নীতির দায় আমাদের সবার। আমরা যদি শুধু সরকারের দিকে আঙ্গুল তুলি, সেটা হবে সবচেয়ে বড় বোকামি। আমরা সবাই এই দুর্নীতির অংশ’।
এই কথাগুলো একজন ধর্মযাজক বা ধর্মগুরু বললে এতটুকু বিস্মিত হতাম না। তারা মানুষকে সৎ থাকার উপদেশ দেবেন, ন্যায়ের কথা বলবেন, সবার কাছে সততা আশা করবেন অর্থাৎ এক ধরনের ইউটোপিয়ান ইল্যুশন তৈরি করে মানুষকে তার মধ্যে যুক্ত করবেন; সেটাই স্বাভাবিক। এটা কোনোক্রমেই একজন প্রশাসকের কথা হতে পারে না। বিশেষ করে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে যেখানে সকল খাতে একজন অতি দক্ষ এবং শক্ত প্রশাসকের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেখানে এই ধরনের ইউটোপিয়ান ইল্যুসিভ কথাবার্তা মানুষকে কোনোভাবেই ভরসা যোগায় না।
দুর্নীতি রোধ করতে যদি সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে সৎ হতে হয় তাহলে আমরা জনগণের করের টাকায় একটা আস্ত প্রশাসন পুষছি কেন? এই অর্থবছরের ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটে সরকার পরিচালনার ব্যয়ই হচ্ছে ৩ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধুমাত্র সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা আর পেনশন গ্র্যাচুইটি বাবদ ব্যয়ই হচ্ছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি। এই বিপুল খরচ করে কেন আমরা এমন প্রশাসক পুষতে যাবো যিনি দায়িত্ব এড়াতে কথা বলেন ধর্মগুরুর মতো। তার অতীত ইতিহাস বলে তিনি অতি মেধাবী মানুষ। তিনি কিছু না বুঝে ‘সরল মনে’ এই কথাগুলো বলেছেন বলে আমি অন্তত মনে করি না।
ফিলিপিন্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রোদ্রিগো দুতার্তে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার আগে ছিলেন দাভাও শহরের মেয়র। তিনি দায়িত্ব নেয়ার আগে যে দাভাও শহর ফিলিপিন্সের সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ শহরগুলোর একটা ছিল, তিনি দায়িত্ব নেবার পর এই শহরটি পৃথিবীর নিরাপদ শহরের তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে চলে গিয়েছিল। ২০১৫ সালে সেই শহর যখন তালিকায় নবম অবস্থানে আসে তখন কীভাবে তিনি এটা করেছেন তার জবাবে বলেন,
‘দাভাও পৃথিবীর নবম নিরাপদ শহর। এটা আমি কীভাবে সম্ভব করেছি বলে আপনি মনে করেন? কীভাবে আমার শহর পৃথিবীর সর্বোচ্চ নিরাপদ শহরের তালিকায় গেল? অপরাধীদের সবাইকে হত্যা করে’।
এরপর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় তার প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে ছিল তার নিজস্ব পন্থায় ফিলিপিন্সকে মাদক মুক্ত করা। তিনি সেটা করেছেনও। এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে প্রায় ৭ হাজার মানুষের মৃত্যুর কথা স্বীকার করা হলেও ফিলিপিন্সের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে গত বছরের মাঝামাঝিতে অন্তত পক্ষে ২৭ হাজার মানুষ বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। তার এই অভিযানে তার দলের মানুষ, তার পরিচিত বা বন্ধুস্থানীয় মানুষ এবং তাদের স্বজনরাও হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলেন।
অপরাধ দমনের জন্য দুতার্তে যা করছেন এটা অবিশ্বাস্য বর্বরতা। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। কোনো রাষ্ট্র একটাও বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত হতে পারে না। কোনোভাবেই নয়। আবার দুর্নীতির অভয়ারণ্যে আমরা কোনো ধর্ম যাজককেও আশা করিনা।
এই লিখায় দুতার্তের কথা মনে পড়লো কারণ, একজন প্রশাসক জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য কী করা উচিত সেটা দেখিয়েছেন দুতার্তে। তিনি বলেছেন, অপরাধী যেই হোক না কেন তাদের সবাইকে তিনি নির্মূল করবেন তার স্টাইলেই। সেটা তিনি করেছেনও।
আমরা একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি। তাই চাই এই দেশের প্রতিটি অপরাধের নিয়মতান্ত্রিক বিচার হবে বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে। কিন্তু প্রশাসকের কাছ থেকে চাই দুতার্তের কঠোরতা।
দেশের আর সব খাতের মতোই একেবারে পচে যাওয়া স্বাস্থ্য খাতে নিযুক্ত নতুন মহাপরিচালকের কাছ থেকে জনগণ দেখতে চেয়েছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে চরম কঠোরতা। তার ঘোষণা করা উচিত ছিল অপরাধী যেই হোক না কেন, যত ক্ষমতাশালীই হোক না কেন তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। অথচ তিনি করছেন জনগণকে সৎ হবার নসিহত।
তিনি দুর্নীতির দায় সরকারকে দিতে রাজি নন। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির জন্য যদি সরকার দায়ী না হয়, তাহলে দায়ী কে? স্বাস্থ্য খাতে সিন্ডিকেট তৈরি করেছে কারা? তার সুবিধাভোগী কারা? এর সঙ্গে যুক্ত লোকজন কারা? তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই, দুর্নীতির সঙ্গে সরকার যুক্ত নয়, তাহলেও এই দুর্নীতি রোধের দায়িত্ব কার কাঁধে বর্তায়? দুর্নীতির দায় সবার বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন? এই দায় কি ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীর? নাকি যিনি আক্রান্ত হয়েছেন তার? নাকি তার পরিবারের? নাকি যারা এই দুর্নীতির বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসছেন তাদের, অর্থাৎ গণমাধ্যমের?
গণমাধ্যম কীভাবে কাজ করবে সেই বিষয়েও তিনি উপদেশ দিতে ভোলেননি। মহামারির মধ্যে সাংবাদিকদের ‘ইতিবাচক মনোভাব’ নিয়ে সরকারের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে এই মহাপরিচালক বলেন, ‘সরকারের সমালোচনা করবেন, ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেবেন। পাশাপাশি তিনি কোনো ভালো কাজ করলে সেটাও তুলে ধরার আহ্বান জানান। ইতিবাচক মনোভাব বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন আমি জানি না। তার মতো প্রাজ্ঞ এবং বিজ্ঞজনের এটি না বুঝবার কোনো কারণ নেই যে, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে সরকারের যে কোনো ভুলত্রুটির সমালোচনা করা, কোনো ঘাটতি থাকলে সেটি তুলে ধরা এবং সর্বোপরি স্বচ্ছতার সঙ্গে সার্বিক বিষয়ে মানুষকে অবহিত করাই মূলধারার গণমাধ্যমের কাজ। সমালোচনা বা ভুলতত্রুটি ধরে দেখিয়ে দেয়া মানেই হলো পাশে থাকা, এটুকু বোঝার মতো জ্ঞান তার থাকার কথা। সমালোচনা বা ভুলত্রুটি ধরাকে নেতিবাচকভাবে দেখা দলীয় কর্মীর পক্ষেই শোভা পায়।
করোনার এই বীভৎস সময়ে একজন কঠোর, দক্ষ, সৎ প্রশাসকের বড় প্রয়োজন ছিল, যিনি কথা ও কাজে শুরু থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান স্পষ্ট করবেন, একজন ধর্মগুরু নয়, যিনি ইতিমধ্যেই নানা অব্যবস্থাপনায় নাকাল হওয়া জাতিকে সৎ হবার নসিহত করবেন।