ঢাকা: টানা মাসব্যাপী বন্যার পর কিছু নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করলেও এক দিনের ব্যবধানে নতুন করে দুটি নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। এ ছাড়া ১০১টি পর্যবেক্ষণাধীন পানিসমতল স্টেশনের ৩৭টিতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, গাইবান্ধাসহ কয়েকটি জেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এদিকে আগে থেকে বন্যাকবলিত এলাকাগুলো এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। পশুখাদ্যের অভাবে গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে ছোট-বড় খামারিরা। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় বিক্রির জন্য এসব পশু কোরবানির হাটেও নিয়ে যেতে পারছেন না। আবার ক্রেতাও আসতে পারছেন না। চারণভূমি তলিয়ে যাওয়ায় বেশি দামে দানাদার খাদ্য কিনতে গিয়ে এরই মধ্যে অনেক খামারি শেষ পুঁজিটুকু শেষ করে ফেলেছেন।
এদিকে গতকাল সকালেও ১০১টি পানিসমতল স্টেশনের ৩৭টিতে পানি বৃদ্ধি পায়। তবে হ্রাস পায় ৬৪টি স্টেশনে। আগের দিন হ্রাস পেয়েছিল ৫৪টি স্টেশনের পানি। এদিকে পানি হ্রাস পেতে শুরু করলেও কোনো নদ-নদীর পানি নতুন করে বিপৎসীমার নিচে আসেনি। উল্টো এক দিনের ব্যবধানে দুটি নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় গতকাল সকালে ২০টি নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদীগুলোর পানিসমতল হ্রাস পাচ্ছে। তবে গঙ্গা ও ঢাকা জেলার আশপাশের নদ-নদীর পানিসমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর ও ভারত আবহাওয়া অধিদফতরের গাণিতিক আবহাওয়া মডেলের তথ্যানুযায়ী আজসহ সামনের আরও দুই দিন দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয়ে ভারি বৃষ্টি হতে পারে। এতে ফের বৃদ্ধি পাবে উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীর পানি। ফলে নতুন করে আবারও প্লাবিত হতে পারে এ অঞ্চলগুলো।
পাউবোর পূর্বাভাস অনুযায়ী, আজ কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, নওগাঁ, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, গাজীপুর, ঢাকা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
গাইবান্ধা : ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট নদ ও করতোয়া নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। করতোয়ার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বাঙালি নদীসংলগ্ন বোচাদহ গ্রামে বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এগুলো হলো মহিমাগঞ্জ, রাখালবুরুজ ও কোচাশহর ইউনিয়নের বোচাদহ, বালুয়া, ছয়ঘরিয়া, শ্রীপতিপুর, কুমিড়াডাঙা, পুনতাইর, পাছপাড়া, গোপালপুর, জিরাই, সোনাইডাঙ্গা, হরিনাথপুর-বিশপুকুর, কাজিরচক, পচারিয়া, মাদারদহ, কাজিপাড়া, ফরিকরপাড়া, পানিয়াসহ ২০ গ্রাম। গাইবান্ধা পাউবোর উদাসীনতায় দেরিতে কাজ শুরু করায় এ বাঁধটি ভেঙে গেছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। পাউবো গতকাল জানায়, ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ৯১ সেন্টিমিটার, ঘাঘটের পানি ৭২ সেন্টিমিটার ও করতোয়ার পানি ১৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বগুড়া : সারিয়াকান্দিতে বন্যায় গবাদি পশুর চারণভূমি ডুবে যাওয়ায় পশুখাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগসূত্রে জানা যায়, উপজেলায় ১ থেকে ৫টি গাভী রয়েছে এমন ১১ হাজার ২১৪টি খামার, ৬ থেকে ১০টি গাভী রয়েছে এমন ১ হাজার ৮৭টি খামার, ১১ থেকে ২০টি গাভী রয়েছে এমন ৩২৪টি খামার, ১০০ থেকে ৫০০ গাভী রয়েছে এমন ১২৯টি খামার রয়েছে। এ ছাড়া ঈদুল আজহা উপলক্ষে খামারিরা ১২ হাজার ৮৫৬টি ষাঁড়, ৩ হাজার ১৫০টি বলদ গরু, ৫ হাজার ৪০টি গাভী ও ১ হাজার ৮১৩টি মহিষ এবং ৮ হাজার ৮৬৪টি ছাগল ও ২ হাজার ৮৩৪টি ভেড়া মোটাতাজা করেছেন। প্রতিদিন এসব খামারে টন টন খাবার প্রয়োজন। অধিকাংশ খাবারের চাহিদা চারণভূমি থেকে পূরণ হতো। বন্যায় চারণভূমি তলিয়ে যাওয়ায় পশুখাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। এতে খামারের মালিকরা বেশি দামে খাবার কিনে লোকসানের মুখে পড়েছেন। সারিয়াকান্দি উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. নুরে আলম সিদ্দিকী জানান, অচিরেই বিনামূল্যে ৩ হাজার ২৫০ কেজি দানাদার খাদ্য খামারিদের মাঝে বিতরণ করা হবে।
শরীয়তপুর : পদ্মা ও কীর্তিনাশা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় শরীয়তপুর জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বন্যার পানিতে প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। শরীয়তপুর সদর, নড়িয়া, জাজিরা, ভেদরগঞ্জ, ডামুড্যা উপজেলার অন্তত ৪০টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। প্রায় ৩ লাখ মানুষ পা?নিবন্দী। দুর্গত এলাকায় চলছে ত্রাণের জন্য হাহাকার। ত্রাণের নৌকা দেখলেই ভিড় করছে মানুষ। টিউবঅয়েল ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ঢাকা-শরীয়তপুর মহাসড়কের গাগ্রীজোড়া, ডোমসার মোড়, কাজিকান্দি, ঢালিকান্দি, মাঝির হাট বাজার, পোড়াকান্দি, ডগ্রী বাজার, নশাসন, জামতলাসহ ১৩ স্থান হাঁটুসমান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
মাদারীপুর : প্রবল বর্ষণ ও নদীর পানি অব্যাহত বৃদ্ধিতে গতকাল মাদারীপুরের চার উপজেলার নিম্নাঞ্চলের নুতন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষ চরম ভোগান্তিতে আছে। জেলায় এ পর্যন্ত ৩৫ ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকার প্রায় ৩৫ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বসতবাড়ি, ফসলি জমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। মাওয়া পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপৎসীমার ৭১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
শিবচরের পদ্মানদী বেষ্টিত চরাঞ্চলের বন্দরখোলা, কাঁঠালবাড়ী, চরজানাজাত, মাদবরের চর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে বন্যা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এ ছাড়া কুমার ও আঁড়িয়াল খা নদের পানি বৃদ্ধির ফলে রাজৈর উপজেলার কবিরাজপুর, ইশিবপুর, বদরপাশা ইউনিয়ন ও মাদারীপুর সদর উপজেলার ধুরাইল, বাহাদুরপুর, শিরখাড়া, ছিলার চর, পাঁচখোলা, কালিকাপুর, খোয়াজপুর, মস্তফাপুর, পেয়ারপুর ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। কালকিনি উপজেলার লক্ষ্মীপুর, বাঁশগাড়ী, সাহেবরামপুরসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়েছে। জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন জানান, মাদারীপুরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৩ হাজার ৭০০ পরিবার। আর নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯৮২টি পরিবার। ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। আগামীতে আরও ত্রাণ বিতরণ করা হবে।
গাজীপুর: গাজীপুর জেলার নিম্বাঞ্চল বন্যার পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। রাস্তা ঘাট বসতবাড়ি স্কুল মসজিদ দোকানপাট পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। বন্যার্তদের ত্রান দিতে ইতোমধ্যে গাসিক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম কাজ করছেন। এর আগে মুক্তিযুদ্ধ বিষযক মন্ত্রী ত্রাণ ও ঈদের উপহার দিয়েছেন।