সব সময়ই শাহেদের পেছনে ছিল অদৃশ্য শক্তির সমর্থন। প্রতারণা মামলায় ২০১৬ সালে তাকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। সে সময় তাকে ছাড়াতে প্রভাবশালীরা তদবির করেছিল। এক সপ্তাহের মধ্যে শাহেদ জামিনে মুক্ত হয়ে আসে। তখন পুরান ঢাকায় কাপড়ের ব্যবসা ছিল শাহেদের। আর ব্যবসা করতে গিয়ে শাহেদের কাছে ৬০ লাখ টাকা পাওনা হয় এক ব্যবসায়ীর। কোনোভাবেই টাকা দিচ্ছিল না শাহেদ। একপর্যায়ে শাহেদ একটি চেক দেয় ব্যবসায়ীকে।
কিন্তু ব্যাংকে টাকা না থাকায় চেকটি ডিজঅনার হয়। এ ঘটনায় মামলা হলে কোতোয়ালি থানা পুলিশ শাহেদকে গ্রেপ্তার করে। ওই সময়ে বারবার বিভিন্ন জনকে ফোন করার চেষ্টা করে শাহেদ। কিন্তু পুলিশ তাকে সেই সুযোগ দেয়নি। গ্রেপ্তারের পর বিষয়টি জানাজানি হলে চাপে পড়েন থানার ওসি। সাতক্ষীরা এলাকার একজন সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক প্রভাবশালী নেতা ও যুব মহিলা লীগের এক নেত্রী তার জন্য তদবির করেন। এমনকি পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাও তার হয়ে কথা বলেন। বিষয়টি তখন ডিএমপি’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আলোচনায় ছিল। পরবর্তীতে পুলিশের ভূমিকার কারণেই মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে জামিনে বের হয়ে আসে শাহেদ। প্রতারণার আরো একটি মামলায় ২০১০ সালে রাজধানীর ধানমণ্ডি থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল শাহেদকে। তখনো নানামুখী তদবিরে বিব্রত হয়েছিল পুলিশ। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতেই ২০১৬ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর তৎকালীন আইজিপিকে চিঠি দেয়া হয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। ওই চিঠিতে শাহেদকে ভয়ঙ্কর প্রতারক প্রকৃতির লোক হিসেবে উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখা-২’র উপ-সচিব নায়েবে আলী স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, শাহেদ বিভিন্ন সময়ে নিজেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ও সেনাবাহিনীর ১৪তম বিএমএ লং কোর্সের অফিসার হিসেবে পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন অপকর্ম করে আসছে। পাশাপাশি ১৯৯৬-২০০১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর এডিসি ছিল বলে পরিচয় দিতো বলেও এতে উল্লেখ করা হয়। এতেও শাহেদের কিছু হয়নি। বরং দিন দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
অর্থ আত্মসাৎ থেকে শুরু করে মারধর, নারীসহ উলঙ্গ ছবি ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল সবই করেছে সে। প্রতারণার ষোলোকলা পূর্ণ করেছে শাহেদ। স্বার্থ উদ্ধারে যখন যেখানে যা প্রয়োজন তাই করতো। এসব করতে গিয়ে মামলা হয়েছে বারবার। এমনকি গ্রেপ্তারও। কিন্তু কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করেনি। কারণ তার পেছনে ছিল প্রভাবশালীদের সমর্থন। নানা কৌশলে প্রভাবশালীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলে শাহেদ। তাই নিজের মিথ্যার খোলস আর পেছনের সমর্থনের কারণে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। শাহেদকে নানাভাবে সমর্থন দিতেন বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য। কয়েকজন সিনিয়র ও তারকা সাংবাদিক। রয়েছেন ডিআইজি পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাও। এমনকি যুব মহিলা লীগের এক নেত্রীর সঙ্গে ছিল তার বন্ধুত্ব। যেকোনো প্রয়োজনে শাহেদের জন্য তদবির করতেন তিনি।
হাসপাতাল ছাড়া নানা ব্যবসায় জড়িত শাহেদ। বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প থেকে শুরু করে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ কাজ করতো সে। ২০১৯ সালের জুন মাসে উত্তরার ড. রফিকুল ইসলাম হেলালীর প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ছয় কোটি টাকার বালু সরবরাহের কাজ দেয় শাহেদ। তখন পূর্বাচলেও একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে বালু সরবরাহ করতো শাহেদ। রফিকুল ইসলাম হেলালী জানান, ৫০ লাখ টাকা পাওনা হওয়ার পর ১১ লাখ ৫৪ হাজার টাকার একটি চেক দেয় শাহেদ। কিন্তু ওই হিসাব নম্বরে টাকা না থাকায় চেকটি ডিজঅনার হয়। তিনবার ডিজঅনারের পর বালু দেয়া বন্ধ করলে অস্ত্র নিয়ে উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৪ নম্বর রোডের অফিসে গিয়ে ফিল্মি কায়দায় হুমকি দিয়ে যায় শাহেদ। খুন করে লাশ গুম করার হুমকি দিয়েছিল সে। এ নিয়ে বিচার সালিশ করলেও থানা-পুলিশমুখো হওয়ার সাহস পাননি হেলালী।
এখানেই শেষ নয়। একপর্যায়ে টাকা দেয়ার নাম করে রিজেন্ট হাসপাতালে ডেকে নেয়া হয় হেলালীর ব্যবসায়িক পার্টনার শেখ জুলফিকার আলী ভুট্টুকে। দিনদুপুরে ডেকে নিয়ে বসিয়ে রাখা হয়। বিকালে তাকে হাসপাতালের একটি কক্ষে আটক করে মারধর করা হয়। একপর্যায়ে বিবস্ত্র করে এক তরুণীর সঙ্গে জোর করে ছবি তোলে শাহেদ। উল্টো শাহেদ টাকা পাবে বলে স্বীকারোক্তি লিখে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর রাখা হয়। নির্যাতনের পর রাত ১১টায় ছেড়ে দেয়া হয় তাকে। তারপর একটি জিডি করলেও ভয়ে আত্মগোপনে ছিলেন শেখ জুলফিকার আলী ভুট্টু। গত ৯ই জুলাই অতীতের এ ঘটনায় উত্তরা থানায় মামলা করেছেন ড. রফিকুল ইসলাম হেলালী।
উল্লেখ্য, করোনা চিকিৎসার নামে প্রতারণা, করোনার নমুনা সংগ্রহ করে ভুয়া রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগে গত ৬ই জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালায় র্যাব। পরে রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহেদসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করা হয়। এ সময় রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখা সিলগালা করা হয়। গত বুধবার ভোরে সাতক্ষীরা থেকে শাহেদকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। প্রতারণার এই মামলা তদন্ত করছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। বর্তমানে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে শাহেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।