ফাহিম সালেহ’র খুনী গ্রেপ্তার

Slider জাতীয়


নিউ ইয়র্ক: ফাহিম সালেহ’র হত্যকারী গ্রেপ্তার হয়েছে। মাত্র ২১ বছর বয়সী এই খুনীর নাম টাইরেস ডেভোন হাসপিল। কৃষ্ণাঙ্গ এই তরুণ এক সময় ছিল নিহত সালেহ’র সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী। তার বিরূদ্ধে সেকেন্ড ডিগ্রি হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। স্থানীয় সময় শুক্রবার সকালে নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট (এনওয়াইপিডি) এই ঘোষণা দেয়।

পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া হাসপিল ছিল নিহত মেধাবী উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহ’র ভেনচার ক্যাপিটাল কোম্পানি ‘অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটাল’ এর চিফ অব স্টাফ। কিন্তু বাস্তবে সে ফাহিমের ব্যাক্তিগত সহকারীর ভূমিকা পালন করতো। অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটালের সব ধরণের লেনদেন দেখাশোনার দায়িত্বও ছিল তার।

প্রায় ৪ বছর সে কাজ করেছে ফাহিমের সঙ্গে। কিন্তু কিছুকাল আগে টাইরেস অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটালের তহবিল থেকে কমবেশি প্রায় ১ লাখ ডলার সরিয়ে ফেলে এবং এক পর্যায়ে তা ফাহিমের কাছে ধরা পড়ে যায়। এই ঘটনার পর ফাহিম তাকে চাকরিচ্যুত করেন এবং চুরিকৃত টাকা কয়েক কিস্তিতে ফেরত দেয়ার জন্য একটা সময়সীমা বেঁধে দেন। এমনকি মানবিক বিবেচনায় সে টাইরেসের এই চুরির অপরাধের জন্য পুলিশের কাছেও কোনো রিপোর্ট করেনি। এটিই শেষ পর্যন্ত তার খুনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চুরিকৃত টাকা ফেরতের পথে না গিয়ে সাবেক বসকে খুন করে তারই দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত কর্মী। এনওয়াইপিডির একজন অফিসার আক্ষেপ করে বলেন, স্রেফ মানবিকতা দেখাতে গিয়েই খুনের শিকার হলো মেধাবী এই উদ্যোক্তা।
শুক্রবার দুপুরে এনওয়াইপিডির একজন অফিসার মানবজমিনকে বলেন, হাসপিল নিজেই হত্যা করেছে তার সাবেক বসকে। কিন্তু নিজের অপরাধের চিহ্ন মুছে ফেলতে প্রতিটি ধাপেই সে আচরণ করেছে অনেকটা পেশাদার খুনীর মতো। দামী ব্র্যান্ডের কালো রঙের পোশাকে পরিপাটি হয়ে এবং মুখে কালো মাস্ক পরে সে এমনভাবে সালেহ’র এপার্টমেন্টে হাজির হয়েছিল যে তাকেই হয়তো চেনাই যায়নি। শুধু তাই নয়, হত্যাকা- থেকে শুরু করে মৃতদেহ টুকরো টুকরো করা এবং রক্তের দাগ মুছে ফেলাসহ সকল আলামত নিশ্চিহ্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতিই ছিল তার। এমনকি ছোট্ট একটি পোর্টেবল ভ্যাকিয়ূম ক্লিনারও বহন করেছিল সে। কিন্তু মিশন শেষ হওয়ার আগেই ফাহিমের খোঁজে আসা কারো একজনের উপস্থিতি টের পায় সে। এ কারণেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শেষ না করেই পালিয়ে যায় খুনী। পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত ব্যক্তিগত সহকারী হিসাবে ফাহিমের এপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে ব্যাক্তিগত জীবনের অনেক তথ্যই হয়তো জানা ছিল টাইরেসের। এমনকি হয়তো সিঁড়িপথের বিশেষ চাবিও ছিল তার কাছে। যে কারণে পালিয়ে যাওয়ার সময় লিফটের পরিবর্তে খুব সহজেই সে সিঁড়িপথ ব্যবহার করতে পেরেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তদন্তকারীর ঘটনাস্থল থেকে জব্দকৃত আলামতের ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে সেখানে টাইরেসের উপস্থিতির নিশ্চিত প্রমাণ পেয়ে গেছেন।
এদিকে গ্রেপ্তার হওয়া টাইরেস ডেভোন হাসপিলের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো তৎপরতার চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না। ফাহিমকে খুনের পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ইচ্ছে করেই সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধ করে রেখেছে কিনা সেটা জানার চেষ্টা করছে পুলিশ।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের জনপ্রিয় রাইডশেয়ারিং কোম্পানি পাঠাও’র অন্যতম সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহ’র খন্ড-বিখন্ড মৃতদেহ গত মঙ্গলবার বিকালে তার ম্যানহাটনের এপার্টমেন্ট থেকে উদ্ধার করে নিউ ইয়র্কের পুলিশ। এর আগে ফাহিমের খালাতো বোন মীরান চৌধুরী ৯১১ নম্বর কল করে ফাহিমকে খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে পুলিশের সাহায্য চান। মীরান সোমবার থেকে অনেকবার টেলিফোনে চেষ্টা করেও ফাহিমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে মঙ্গলবার দুপুরের পর সরাসরি তার এপার্টমেন্ট ভবনে গিয়ে হাজির হন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তিনি ফাহিমের এপার্টমেন্ট থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাননি। এরপরই তিনি পুলিশের সাহায্য চেয়ে ফোন করেন। ওইদিন বেলা সাড়ে ৩টার দিকে এনওয়াইপিডি’র প্রিসিঙ্কট (থানা বা পুলিশ স্টেশন) ০০৭ এর একটি দল ওই এপার্টমেন্টে গিয়ে ফাহিমের খন্ড-বিখন্ড মৃতহে আবিষ্কার করে। এরপর ভবনটির সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, ফাহিম সর্বশেষ গত সোমবার দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে তার এপার্টমেন্টে প্রবেশ করেন। শর্টস ও টি-শার্ট পরিহিত ফাহিম যখন নিচতলা থেকে লিফটে চড়েন তখন কালো পোশাকে আবৃত ও কালো মাস্ক পরা আরেক ব্যক্তিও তার সঙ্গে লিফটে ওঠে। তার হাতে ছিল ব্রিফকেস টাইপের একটি বাকসো। ফাহিমকে সন্দেহের দৃষ্টিতে ওই আগন্তুকের দিকে তাকাতেও খো গেছে। সিসি ফুটেজে আরও দেখা যায় যে, সন্দেহভাজন লোকটি সপ্তম তলায় ফাহিমের সঙ্গেই নেমে পড়ে এবং এক পর্যায়ে ফাহিম তার এপার্টমেন্টের দরজা খোলামাত্রই তাকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে ফেলে সে। লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর পরের দৃশ্য আর ফুটেজে আসেনি।
মেধাবী এই প্রযুক্তি-উদ্যোক্তার নৃশংস খুনের ঘটনা বিশ্বজুড়েই বড় সংবাদ হিসাবে স্থান পায় সকল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। নিউ ইয়র্কের পুলিশ ডিপার্টমেন্টও এই মামলাটিকে নেয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের তালিকায়। নানা রকম তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ফাহিমের সাবেক ব্যাক্তিগত সহকারী টাইরেস হাসপিলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বৃহস্পতিবার প্রথমে পুলিশের হেফাজতে নেয়া হয়। এরপর ফরেনসিক পরীক্ষার রিপোর্ট এবং জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তদন্তকারী নিশ্চিত হয় যে, ২১ বছর বয়েসী এই কৃষ্ণাঙ্গ তরুণই খুন করেছে তার সাবেক বসকে। এরপরই তাকে গ্রেপ্তারের ঘোষণা দিয়ে সেটা গণমাধ্যমের সামনে প্রকাশ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুস্যাটসের বেন্টলি ইউনিভার্সিটিতে ইনফরমেশন সিস্টেমের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নেয়া ফাহিম সালেহ বাংলাদেশের মতো নাইজেরিয়াতেও গোকাডা নামের আরেকটি মোটরসাইকেল ট্যাক্সি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তার বাবা, মা ও বোন নিউ ইয়র্ক শহর থেকে ৮০ মাইল দূরের ছোট্ট শহর পুকেপসিতে বসবাস করেন। তার বাবা সালেহ আহমেদের বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *