সাইফুল ইসলাম, টাঙ্গাইল প্রতিনিধিঃ রান্নাঘরে হাঁটুপানি হয়েছে অনেক আগেই। জ্বালানির উপকরণ আর চারটি ছাগল রাখার ঘরেও হাঁটুপানি। গত এক সপ্তাহ আগে থাকার ঘরের মেঝেতে পানি ঢুকেছে। দুই কক্ষের ভাঙা টিনের ঘরের এক পাশে প্রায় হাঁটুপানি। অপর দিকেও পানি ঢুকেছে। কেবলমাত্র একটু উঁচু বারান্দায় পানি নাগাল পায়নি।
টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলার মহেড়া ইউনিয়নের কড়াইল গ্রামের দিনমজুর রোকন মিয়া ও শিল্পী আক্তার দম্পতি ঘরের ভেতর পানি, সাপ, পোকামাকড়, গৃহপালিত পশুর সঙ্গে বসবাস করছেন। দিনমজুর রোকনের ভাষায়,”ঘরে প্রতিদিন সাপ আসে। সাপ মারতে মারতে তাঁর এমন অবস্থা হয়েছে যে ঘুমের মধ্যেও মনে হয় যেন সাপ মারছেন।”
এদিকে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় যে, “উঁচু জায়গাটিতে মাটির তৈরি চুল্লিতে কাঁঠালের বিচি ভাজছেন গৃহবধূ শিল্পী আক্তার। তা খেয়েই দুপুর কাটাবেন। রাতে কী খাবেন, তা নিয়ে চিন্তিত তিনি।”
বরাদ্দ না পেলেও মির্জাপুরের কদিমধল্যা-ছাওয়ালী রাস্তার পাশে সরকারি জায়গায় ঘর তুলে দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে বাস করছেন রোকন মিয়া। প্রতিবছর ভরা বর্ষায় তাঁর বাড়ির উঠানে পানি আসে। আর এবার পানি একটু বেশিই উঠেছে। ঘরের মেঝের একপাশে প্রায় হাঁটুপানি হয়ে গেছে। এতে দুই কক্ষের ঘরের একপাশে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী আর অপর পাশে ছেলেমেয়ে থাকে। তবে বাড়িতে পানি ওঠায় ঘরে তাঁদের সঙ্গে যোগ হয়েছে পোষা চারটি ছাগল। ছাগলগুলোর থাকার ঘরে পানি ঢুকে যাওয়ায় সেগুলোকে তাঁদের শোবার ঘরের এক পাশে রেখেছেন। এ ছাড়াও হাঁসের কয়েকটি বাচ্চাও তাঁদের সঙ্গেই থাকে। এর সঙ্গে বাড়তি যোগ হয়েছে কেঁচো আর সাপের উৎপাত।
রোকন মিয়া জানিয়েছেন, “বেশির ভাগ সময়ই গাছ কাটার কাম করি। আর যহন যে কাম পাই, তাই করন লাগে। অহন আমার কোনো কামই নাই। মাইয়াডা গার্মেন্টসে কাম করতাছে। কিছু টাকা জমানো আছিল। তা–ও শ্যাষ। ম্যায়ার কামাই দিয়্যা দুই-এক কেজি কইর্যা চাল আনতাছি আর খ্যাইতাছি।”
রোকন মিয়া আরও বলেছেন, “অহন খুবই কষ্ট অইতেছে। করোনার কারণে তো এমনেই কাম বন্ধ। তার ওপর বন্যা। ঘরে হুয়া-বয়্যা দিন চলতাছে। পানির কারণে সাপের লগে যুদ্ধ কইর্যা চলতাছি। ডেইলি ঘরে পানির সঙ্গে সাপ আইতাছে। মাথার কাছে ফচকা (টেঁটা) নিয়া রাখি। মাঝেমধ্যে সাপ মারি। ঘুমের ঘুরেও মনে অয় সাপ মারতে থাকি।”
শিল্পী আক্তার জানান, “থাকার জায়গা নাই। সরকারি জাগায় থাকি। দুই ছেলেমেয়ে টাকার অভাবে লেখাপড়া করিয়া পারি নাই। জীবন তো বাঁচান লাগবো। এই জন্য ম্যায়াডা গার্মেন্টসে কাম নিছে। আর পোলাডা এক দোকানে কারেন্টের কাম হিকতাছে। টাকাপয়সা নাই। খুব কষ্টে চলতাছি। কাজকাম নাই।”
শিল্পী আরও বলেছেন, “পানির মধ্যেই থাকতাছি। পাকের ঘরে পানি। পায়খানাও পানিতে ডুইবা গ্যাছে। খুবই কষ্টে আছি। বারিন্দায় অহনও পানি পায় নাই। এনে চৌকা রাখছি। একজনে কাঁঠাল দিছিল। সেই কাঁঠালের বিচি ভাজতাছি। তাই খাইয়া দুপুরডা চালিয়া দিমু।”
স্বামী–স্ত্রী বলেছেন, “স্থানীয় কয়েকজন তাঁদের সাহায্য দিতে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিয়েছেন কয়েকবার। তবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সাহায্য তাঁরা পাননি।”
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে, “ওই এলাকার কয়েকটি কাঁচা-পাকা রাস্তা পানিতে ডুবে গেছে। তবে দরিদ্র ওই পরিবার ছাড়া এখনো অন্য কারও বাড়ির উঠানে পানি ওঠেনি।”
মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবদুল মালেক জানিয়েছেন, “সরকারের পর্যাপ্ত সুবিধা থাকার পরও এত দুর্ভোগে কেউ থাকার কথা নয়। ওই পরিবারকে দ্রুত খাদ্যসহায়তাসহ প্রয়োজনীয় সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে।”