এরশাদের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকীতেই আদর্শিক চ্যালেঞ্জের মুখে জাতীয় পার্টি!

Slider জাতীয় টপ নিউজ রাজনীতি

ঢাকা: জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আগামীকাল মঙ্গলবার। গত বছরের এদিনে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। করোনা পরিস্থিতির কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দিবসটি পালনে এরশাদ ট্রাস্ট, ব্যক্তিগতভাবে বেগম রওশন এরশাদ এবং জাতীয় পার্টি দলীয়ভাবে দেশব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করবে। একই সঙ্গে দিবসটি পালন করবে জাতীয় পল্লী পার্টি নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল। এই দলের প্রধান হলেন ব‌্যারিস্টার দিলারা খন্দকার।

জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই নতুন দল আত্মপ্রকাশ করবে। দলের অফিস, খসড়া গঠনতন্ত্র, ঘোষণাপত্রসহ প্রয়োজনীয় প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। সারা দেশে সাংগঠনিক কাঠামো ঠিক করে দলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন দিলারা খন্দকার।


এরশাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে রাজনীতি মাঠে আছে তারই হাতে গড়া দল জাতীয় পার্টি। এর বর্তমান নেতৃত্বে রয়েছেন তার ছোটভাই জিএম কাদের। নতুন দল গঠন সম্পর্কে ব‌্যারিস্টার দিলারা বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছিলাম। জাতীয় পার্টি মানেই এরশাদ। কিন্ত স‌্যার মার‌া যাওয়ার পর জিএম কাদেরসহ বর্তমানে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা স্যারের আদর্শ থেকে দূরে সরে গেছেন। পার্টি আছে কিন্তু আদর্শ নেই। এটি জিএম কাদের জাতীয় পার্টি হয়ে গেছে। স‌্যারের প্রতি ভালোবাসা থেকে তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছি। নতুন দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি। স‌্যার দেশ ও জাতির জন‌্য নিবেদিত ছিলেন। তাকে অনুসরণ করে মানুষের সেবা করব। স‌্যারের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করে আধুনিক বাংলাদেশ গড়বো।

প্রবীণ আইনজীবী ব‌্যারিস্টার রফিকুল হকের জুনিয়র হিসেবে তারই উৎসাহে ২০০৮ সালে যোগ দেন জাতীয় পার্টিতে। অল্পদিনেই পার্টির চেয়ারম‌্যানের আস্থাভাজনে পরিণত হন। প্রাথমিক সদস‌্য পদ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কিমিটির সদস‌্য তারপর দলের যুগ্ম মহাসচিব করা হয় তাকে।

জাতীয় পার্টির এমপি ড. টিআই এম ফজলে রাব্বি অসুস্থ ও নিস্ক্রিয় হলে এরশাদের নির্দেশে গাইবান্ধা-৩ (পলাশবাড়ি সাদুল্লাপুর) আসনে জাপাকে সংঘঠিত কর‌ার দায়িত্ব নেন দিলারা। অল্প সময়ে নজর কাড়েন এরশাদের। একাধিবার তার দলীয় কর্মসূচিতেও যোগ দেন এরশাদ। একপর্যায়ে রানিং এমপি ফজলে রাব্বিকে ছিটকে ফেলে দশম সংসদ নির্বাচনে লাঙল এর টিকিট পান দিলারা। নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি, কিন্তু নির্বাচন প্রত‌্যাহারের ঘোষণা দিলে তিনিও সরে দাঁড়ান। একাদশ সংসদ নির্বাচনেও তিনি অংশ নেন। কিন্তু এমপি হতে পারেননি।

২০১৬ সালে দিলারাকে এরশাদ রাজনৈতিক উপদেষ্টা করেন। কিছুদিন পর প্রেসিডিয়াম সদস‌্য নির্বাচিত করেন। এরশাদের মৃত‌্যুর আগ পর্যন্ত তিনি উপদেষ্টা ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস‌্য ছিলেন। এরশাদের মৃত‌্যুর পর নতুন কমিটিতে তাকে কোন পদে আর রাখা হয়নি।

জাতীয় পার্টির দলীয় সূত্র জানায়, সকালে দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে রংপুরে এরশাদের সমাধি জিয়ারত করে দুপুরে ফিরে কাকরাইল ও বনানীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পৃথক অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন জিএম কাদের। বেলা ১১টায় গুলশানে রওশন এরশাদ বাসভবনে মিলাদ মাহফিল ও সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।

এদিকে দিলারা খন্দকার তার নিজের ফেসবুক ওয়ালে মৃত্যুবার্ষিকী পালন উপলক্ষ্যে লিখেছেন, যেহেতু করোনা মহামারির কারনে জাতীয় পল্লী পার্টি (জেপিপি) আপাতত অনলাইন প্রচারণায় গুরুত্ব বেশি দিচ্ছে সেহেতু জাতীয় পল্লী পার্টির সাথে সম্মানিত যারা কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন কিংবা করবেন তাদেরকে অনুরোধ করব আপনারা একটা অনলাইন গ্রুপ তৈরী করে প্রচারণা চালান। গত দু তিন দিন যাবত লক্ষ করছি জাতীয় পল্লী পার্টির অফিসিয়াল অনলাইন প্রচারণায় বাধা দেওয়া হচ্ছে। তাই আপনারদেরকে সতর্কতার সাথে কাজ করতে হবে যাতে কেউ আপনাদের আইডি হ্যাক করতে না পারে। বাধা আসবে, সে বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে হবে, অনেক পরিশ্রম করতে হবে, জয় হবেই ইনশাআল্লাহ্। আমার আইডি ফলো করুন সেখানে টাইম টু টাইম নির্দেশনা থাকবে। সবাই ভাল থাকুন ।

এদিকে এরশাদের কবরে স্থপিত ফলকে দেখা যায়, এরশাদের জন্মদিন ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু দিলারা খন্দকার ওই ফলকের ছবি দিয়ে নিজের ফেসবুকে লিখেছেন এরশাদ সাহেবের জন্মদিন ২০ মার্চ। জন্মদিনটি সংশোধনের জন্য তিনি স্থানীয় মেয়রের প্রতি অনুরোধ জানান।

আজ সোমবার রাত ৮টায় জাতীয় পল্লী পার্টির প্রধান ব‌্যারিস্টার দিলারা খন্দকার বলেন, জাতীয় পল্লী পার্টির পক্ষ থেকে আগামীকাল ১৪জুলাই এরশাদ স্যারের ১ম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে সারাদেশ দিনব্যাপি পবিত্র কোরান খতম দোয়া ও বাদ আসর মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।

ব‌্যারিস্টার দিলারা খন্দকার বলেন, এরশাদ স্যার জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। তার নীতি ও আদর্শের মধ্যে জাতীয় পার্টি নেই। স্যারে মৃত্যুর পর প্রথম প্রেসিডিয়ামের সভায় জি এম কাদের সাহেব বক্তব্যের প্রথমেই এরশাদের সাহেবের নাম ভুলে গিয়েছিলেন। পরে ক্ষমা চেয়ে নাম উচ্চারণ করেন। এরশাদ স্যারের সমাধি সংস্কারের জন্য বার বার আমি দাবী করলেও কেউ শুনেনি। পরে রংপুরের মেয়র সমধির সংস্কার করেছেন।

দিলারা খন্দকার বলেন, জুলাই মাসে এরশাদ সাহেব মারা গেছেন। জুলােই মাস আমাদের জন্য শোকের মাস। এই মাস উপলক্ষে জাতীয় পার্টি কোন দলীয় প্রস্তুতির কথাও বলেনি। কালকে স্যারের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী। তাই দায়ে পড়েই তারা কবর জিয়ারত করবেন। এটা দায়সারা কাজ।

জাতীয় পল্লী পার্টির প্রধান ব‌্যারিস্টার দিলারা খন্দকার আরো বলেন, করোনা পরস্থিতির পর আনুষ্ঠানিকভাবে দল ঘোষনা হবে। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা উপজেলা ও কেন্দ্রে কমিটি হবে। তৃনমূল কমিটির মতামতের ভিত্তিতে কেন্দ্রিয় কমিটি গঠন করা হবে। নতুন এই দলে জাতীয় পার্টির অনেক বড় বড় নেতই আসবেন আশা করি। অনেকেই আমার সাথে যোগাযোগ করছেন। আশা করছি, কেন্দ্র ও তৃনমূলের অনেক বড় বড় নেতাই এরশাদের স্যারের নীতি ও আদর্শে গড়া সংগঠন জাতীয় পল্লী পার্টিতে থাকবেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এরশাদ সাহেবের আদর্শের দাবীদার দুটি রাজনৈতিক দল হওয়ায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে জাতীয় পার্টি। এরশাদ সাহেবের জীবদ্দশায় ভাঙ্গা-গড়ার খেলা হলেও তা কোন মতে সমাধান হয়েছে। কিন্তু এরশাদের মৃত্যুর পর ভাঙ্গা গড়া শুরু হলে রাজনৈতিক অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা সময় বলে দেবে। তবে নতুন দল জাতীয় পল্লী পার্টির প্রধান বলেছেন, তিনিই এরশাদের নীতি ও আদর্শকে বাস্তবায়ন করে তার দলকে এরশাদের দল করতে সক্ষম হবেন।

প্রসঙ্গত: এরশাদ অবিভক্ত ভারতের কোচবিহার জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পরে তার পরিবার রংপুরে চলে আসেন। রংপুরেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এরশাদ। ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়ে ১৯৭১-৭২ সালে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ওই বছরই আগস্ট মাসে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে তাকে সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এরশাদকে সেনাবাহিনীর প্রধান পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৭৯ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন এরশাদ। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন তিনি। ১৯৯১ সালে এরশাদ গ্রেফতার হন। ১৯৯১ সালে জেলে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় এরশাদ রংপুরের পাঁচটি আসনে বিজয়ী হন। ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনেও এরশাদ সংসদে পাঁচটি আসনে বিজয়ী হন। ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি জামিনে মুক্ত হন তিনি। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি ১৪টি আসনে জয়ী হয়। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের সঙ্গে মহাজোট গঠন করে তার দল। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তার দল ২৭টি আসনে বিজয়ী হয়। এরপর দশম ও সবশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি চলতি জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *