ঢাকা: দেশের কোথাও কোথাও বন্যা পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হলেও এখনো বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অব্যাহত রয়েছে নদীভাঙন। বন্যাকবলিত এলাকায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করলেও এখনো পানিবন্দী লাখো মানুষ। ডুবে গেছে ফসলের বীজতলা, মাছের খামার। রাস্তা ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন অনেক এলাকার মানুষ। এর মধ্যেই চলতি সপ্তাহ শেষে উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে আরও বড় বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। আর এ বন্যা দীর্ঘায়িত হতে পারে এক মাসেরও বেশি সময়।
গতকাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে, আগামী দু-এক দিনের মধ্যে ভারতের আসাম ও মেঘালয়সহ উজানে ভারী বৃষ্টিপাত হবে। এর প্রভাবে চলতি সপ্তাহ শেষে আরও বড় বন্যার শঙ্কা রয়েছে। এ বন্যা এক মাসেরও বেশি সময় অবস্থান করতে পারে। আর ঢাকা মহানগরীর পূর্বদিকে শহররক্ষা বাঁধ না থাকায় পানির চাপ বেশি হলে ডেমরা, বনশ্রীসহ কিছু এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ঢাকার আশপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও শীতলক্ষা নদীর পানি ইতিমধ্যে বেড়েছে। ঢাকার দোহার ও মুন্সীগঞ্জের নিম্নাঞ্চলে ইতিমধ্যে বন্যার প্রভাব পড়েছে। ড্রেনের তুলনায় নদীর পানির উচ্চতা বাড়লে নগরীতে জলাবদ্ধতা তৈরি হতে পারে। আসন্ন বন্যায় ঢাকার নিম্নাঞ্চল ও নারায়ণগঞ্জ প্লাবিত হতে পারে।
এদিকে দেশের কিছু এলাকায় নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করলেও অনেক এলাকাই এখনো বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে। নদীভাঙনে বিলীন হচ্ছে বসতভিটা, কৃষিজমি। কুড়িগ্রামের উলিপুরে তিস্তার গর্ভে চলে গেছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বন্যার পানির প্রবল চাপে রাস্তা ভেঙে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর এবং বাসাইল উপজেলার সঙ্গে গত পাঁচ দিন ধরে সরাসরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সুনামগঞ্জে পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় ভেসে গেছে ৫২৯ হেক্টর জমির পুকুর ও দিঘির মাছ। অনেক এলাকায় পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে ধানের বীজতলা ও সবজি খেত। ঝুঁকিতে আছে পাকতে শুরু করা আউশ ধান। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, সপ্তাহের মধ্যে বৃষ্টি বেড়ে আসতে পারে বন্যার দ্বিতীয় ধাক্কা। এতে প্লাবিত হতে পারে দেশের ৪০ শতাংশ জেলার নিম্নাঞ্চল। আমাদের বিভিন্ন জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা বন্যার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়েছেন। গাইবান্ধা : এ জেলায় সব নদীর পানি কমতে থাকলেও গতকাল করতোয়ায় পানি ৯১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি ২১ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ঘাঘটের পানি ১৯ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার নিচে ও তিস্তার পানি ১ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ৪৮ সেন্টিমিটার নিচে চলে গেছে। অন্যদিকে করতোয়ার পানি ৯১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে করতোয়া এখনো বিপৎসীমার নিচে রয়েছে। কুড়িগ্রাম : সবকটি নদ-নদীর পানি কমে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে বানভাসিদের দুর্ভোগ এখন চরমে। বন্যার পানি কমলেও আশ্রয়কেন্দ্রসহ বিভিন্ন উঁচু বাঁধে থাকা মানুষগুলো এখনো বাড়ি ফিরতে শুরু করেনি। অনেকে আবারও বন্যার আশঙ্কায় বাঁধেই থেকে যাচ্ছেন। আবার অনেকের ঘরবাড়ি এখনো পানির নিচে থাকায় যেতে পারছেন না। বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির অভাবে দেখা দিয়েছে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানা পানিবাহিত রোগ। স্বাস্থ্যবিভাগ কাজ করার কথা বললেও অনেক পরিবার খাবার স্যালাইন ও ওষুধ সংকটে রয়েছে। বন্যায় জেলার আট শতাধিক পুকুর ও জলাশয়ের মাছ ভেসে গেছে। নয় হাজার ৭৮৯ হেক্টর জমির আমন বীজতলা ও বিভিন্ন সবজি ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া পানি কমার সঙ্গে শুরু হয়েছে নদীভাঙন।
গত দুই দিন ধরে রাজারহাট উপজেলার কুমরপাড়া, সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের সারডোব গ্রামে বাঁধে ধস, চিলমারী ও উলিপুরের কয়েকটি জায়গায় দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। রংপুর : কয়েক দিন ধরে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও রংপুর অঞ্চলে এখনো প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর ফসলের জমি পানির নিচে রয়েছে। চরাঞ্চলের মানুষ এখনো চরম দুর্ভোগে রয়েছে। পানি কমায় অনেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করলেও জমির ফসল নিয়ে চিন্তিত। বন্যায় রংপুর অঞ্চলের কমপক্ষে ২০ হাজার কৃষকের বোরো বীজতলা, সবজি, ভুট্টা, বাদামসহ অন্যান্য ফসল এখনো পানির নিচে রয়েছে। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ আলী জানান, রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় ১৩ হাজার ৪৬১ হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। পানি কমলে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা যাবে। জামালপুর : যমুনার পানি বিপৎসীমার নিচে নেমে আসায় জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় ২৩ সেন্টিমিটার কমে মঙ্গলবার বিকালে বাহাদুরাবাদঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে পানি। বেশিরভাগ বসতবাড়ি থেকে পানি নেমে গেলেও এখনো যমুনা তীরবর্তী এলাকার বসতবাড়িতে পানি রয়ে গেছে। এখনো বন্যাদুর্গতরা সরকারি আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়াও বিভিন্ন উঁচু সড়ক ও বাঁধে আশ্রয় নিয়ে আছেন। বাড়িঘর থেকে পানি নামলেও জলকাদার কারণে বাড়ি ফিরতে পারছেন না দুর্গতরা। এবারের বন্যায় জেলার ১৩ হাজার ৩৪৩ হেক্টর জমির ফসল বন্যার পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। নিম্নআয়ের মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়ে চরম খাদ্য সংকটে রয়েছে। জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধিরা পর্যায়ক্রমে বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করছেন। সিরাজগঞ্জ : যমুনা নদীর পানি কমছে কিন্তু বানভাসিদের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। এখন পর্যন্ত কেউ বসতভিটায় ফিরে যেতে পারেননি। অনেকেই ওয়াপদাবাঁধে ঝুপড়ি তুলে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বন্যায় সিরাজগঞ্জ সদর, কাজিপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলায় ৩৩টি ইউনিয়নের ২১৬টি গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ এখনো পানিবন্দী রয়েছেন। পাঁচ শতাধিক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নষ্ট হয়েছে চার হাজার হেক্টর ফসলি জমি। ১৬ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে এনায়েতপুর, চৌহালী ও কাজিপুরের খুদবান্দি এলাকায় ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। প্রতিদিন বসতভিটা বিলীন হচ্ছে। এতে নিঃস্ব হয়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে অনেক পরিবার। টাঙ্গাইল : এ জেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করলেও ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। গতকাল যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে, ঝিনাই নদীর পানি ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং ধলেশ্বরীর পানি ৬৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ত্রাণ শাখা জানায়, টাঙ্গাইলে ১৩৭টি গ্রামের ২৬ হাজার ৯২২টি পরিবার এবং এক লাখ ২৯ হাজার ১২১ জন ব্যক্তি বন্যায় ক্ষতির শিকার হয়েছেন। ৫৭২টি বাড়ি নদীতে একেবারে বিলীন এবং এক হাজার ৬৫টি বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নাগরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্পূর্ণ নদীগর্ভে চলে গেছে। ৫০ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা ও সাত কিলোমিটার পাকা সড়ক, তিনটি কালভার্ট এবং ২.৫ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে।