ঢাকা: মানব দুর্ভোগ ও অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়াও করোনা মহামারি বিভিন্ন দেশের মধ্যে, এমনকি আন্তর্জাতিকভাবে তীব্র বিভক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছে। কিন্তু অর্থনীতি, আর্থিক খাত ও বৈশ্বিক সমাজ ব্যবস্থাকে নতুন করে সাজানোর একটি বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে কোভিড-১৯। ধনী-গরিব সবার জন্য প্রযোজ্য হতে হবে করোনার টীকা। নিক্কি এশিয়ান রিভিউকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে এসব কথা বলেছেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী একমাত্র বাংলাদেশি এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বালাদেশ এবং বিস্তৃত বিশ্বের জন্য ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে ১৯৭০ এর দশকে তিনি একটি দরিদ্র গ্রাম সফরে গিয়েছিলেন। সেখানেই তিনি গ্রামের মানুষের দুর্দশা অনুভব করেন। তার ফলেই ১৯৮৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন গ্রামীণ ব্যাংক।
এখান থেকে হতদরিদ্রদের কোনো জামানত ছাড়াই ঋণ দেয়া হয়। তাদেরকে ব্যবসা করতে মূলধন দেয়া হয়, যাতে এসব মানুষ আত্মনির্ভরশীল হতে পারে। দীর্ঘ ওই সাক্ষাতকারে ড. ইউনূস বলেছেন, পুরনো অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনায় জোর দেয়া হয়েছে এমন ব্যবসায়, যেখানে থাকে আত্মস্বার্থ। কিন্তু একজন সামাজিক উদ্যোক্তার প্রেক্ষাপটে তিনি জোর দিয়েছেন সমাজের অভিন্ন স্বার্থের দিকে। ব্যক্তিগত শূন্য লভ্যাংশের দর্শনের ওপর ভিত্ত করে নতুন অর্থ ব্যবস্থার প্রয়োজন নতুন অর্থনীতিতে বলে তিনি মনে করেন। এখানে তার সঙ্গে প্রশ্নোত্তর আকারে ওই সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন: করোনা ভাইরাস সঙ্কট কিভাবে বিশ্বকে পরিবর্তন করে দিচ্ছে এবং মানুষের জীবনধারাকে পাল্টে দিচ্ছে?
উত্তর: করোনাভাইরাস আমাদের সবাইকে একটি অভিন্ন সুযোগ এনে দিয়েছে আমাদের পুরো ব্যবস্থায় পিছন ফিরে তাকানোর এবং তা নতুন করে সাজিয়ে কাজে লাগানোর। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সম্পদ কুক্ষিগত করা এবং ভয়াবহ বেকারত্বের মাধ্যমে এই পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্বকে এর শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল ওল্ড পৃথিবী বা পুরাতন পৃথিবী। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের আগে যেখানে ছিল এই বিশ্ব, তাকে সেখানে ফিরে যেতে দেয়া উচিত হবে না। আমরা যেখানে ছিলাম সেখানে ফিরে যাওয়া মোটেও উচিত নয়। এটা ছিল এক ভয়ঙ্কর পৃথিবী, যেখান থেকে আমরা বেরিয়ে আসছি। তাই আমরা এখন আরেকটি দিকে, একটি নতুন বিশ্বের দিকে যেতে চাই। যেখানে ওইসব ভয়ঙ্কর জিনিসগুলোর অস্তিত্ব থাকবে না।
প্রশ্ন: করোনা ভাইরাস সঙ্কটে ব্যবসার ভূমিকা কি?
উত্তর: ব্যবসার বিদ্যমান ভূমিকা খুব ভালভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এটা আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে, মুদি দোকানি বা বেকারি ক্রেতাদের জন্য ভালবাসার জন্য তার সেবা প্রসারিত করেন না। তিনি এটা করেন নিজের স্বার্থের জন্য। পুরো মানবজাতি তার স্বীয় স্বার্থের জন্য পরিচালিত- এটাই বলে অর্থনীতির তত্ত্বে। ব্যবসা হলো এমন একটি হাতিয়ার যার মাধ্যমে এই মানুষরা তাদের নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে পারে। অর্থনীতিতে এটা পরিষ্কার করেছে যে, সর্বোচ্চ স্বীয় স্বার্থ হলো অর্থনৈতিক লক্ষ্য। এটাকে পরিবর্তন করতে হলে আপনাকে ফিরে যেতে হবে অর্থনীতির মূলে। অর্থনৈতিক কোনো ব্যক্তিকে স্বীয় স্বার্থে পরিচালিত- এর পরিবর্তে তাকে সংজ্ঞায়িত করতে হবে এমন একজন হিসেবে, যেখানে তিনি পরিচালিত হবেন নিজের স্বার্থ এবং অভিন্ন স্বার্থের জন্য।
ফলে আমাদের দু’রকম ব্যবসা আছে। একটি হলো স্বীয় স্বার্থের বাণিজ্য, যেখানে সর্বোচ্চ লাভ করা যায়। অর্থাৎ আমরা সর্বোচ্চ লাভ করি আমাদের নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। এরপরে আমাদের থাকে অভিন্ন স্বার্থ। তাই আমরা আরেক রকম ব্যবসাকে ডিজাইন করবো। সেটা হলো অভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য বাণিজ্য বা ব্যবসা। এর একটি হলো কোম্পানির সর্বোচ্চ লাভ। অন্যটি হলো কোম্পানির ব্যক্তিগত লাভের অংশ শূন্য। এটাকে আমরা সামাজিক বাণিজ্য বলে থাকি।
প্রশ্ন: বর্তমান সঙ্কটের অধীনে অর্থনৈতিক ব্লক, সংরক্ষণবাদিতার মতো বিশ্বায়ণের মতো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে অনেক দেশ। কিছু দেশে সামাজিক ও জাতিগত বিভাজন রয়েছে।
উত্তর: এক্ষেত্রে আমার ব্যাখ্যা হলো, এর মূলে রয়েছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দর্শন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দর্শন স্বার্থপরতা। সেখানে আপনি সবকিছুই নিজের থাবার মধ্যে নিতে চাইবেন। বিশ্বায়নের নামে আপনি অন্য অনেক দেশে যেতে চাইবেন। কিন্তু অন্য দেশকে সুবিধা দেয়ার জন্য যাবেন না। আপনি অন্য দেশ থেকে সবকিছু গ্রাস করতে চাইবেন। এটাকে আমরা বলি বিশ্বায়ন। কিন্তু বিস্তৃত অর্থে এটা হলো প্রকৃতপক্ষে লাভকে সর্বোচ্চকরণ।
অভিন্ন স্বার্থ এবং ব্যক্তি স্বার্থের মধ্যে পরিষ্কার সংঘাতের কারণে করোনা সঙ্কটের সময়ে সমস্যাগুলোর বিস্তার ঘটেছে। অর্থনীতির কাঠামোর ভিতরে শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে অভিন্ন স্বার্থ আনার মাধ্যমে এই সংঘাতের সমাধান অর্জন করা যেতে পারে। এটা করার জন্য করোনা সঙ্কট হচ্ছে সবচেয়ে ভাল সময়। আসুন আমরা একটি নতুন অর্থনৈতিক ইঞ্জিন বা চালক গড়ে তুলি, যা এই উভয় স্বার্থকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসবে।
একটি উদাহরণ হিসেবে এখানে করোনা টীকার কথা বলা যেতে পারে। যখন এই টীকা আসবে, সব দেশই প্রথমে তা নিজেরা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করবে। এটাই স্বার্থপরতা। যদি স্যানোফির মতো কোম্পানি প্রথম টীকা তৈরি করতে পারে এবং তা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যায়, তাহলে এর দাম হবে অনেক বেশি। সর্বোচ্চ লাভ লুফে নিতে তাদের এটা করা উচিত হবে না। এটাই অভিন্ন স্বার্থ। টীকা সবার জন্যই পর্যাপ্ত থাকা উচিত হবে, এমনকি দরিদ্ররাও যেন তা পায়।
প্রশ্ন: এই সঙ্কটকালে কি ক্ষুদ্রঋণের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে?
উত্তর: নতুন অর্থনীতিতে নতুন ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেম প্রয়োজন হবে। বর্তমানে যে ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেম আছে তা এই পৃথিবীর এবং এর মানুষের স্বার্থের পরিপন্থি। এটা হলো বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ সৃষ্টির একটি বাহন, অব্যাহতভাবে সম্পদ পুঁজি করার যান, যা এই পৃথিবী এবং এর অধিবাসীদের টিকে থাকার ক্ষেত্রে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেমের শতকরা ৯৯ ভাগ রিসোর্স বা উৎস শতকরা মাত্র এক ভাগ অবশিষ্ট রাখে বৈশ্বিক জনগোষ্ঠীর জন্য।
আমাদেরকে এমন একটি নতুন ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেম সৃষ্টি করা প্রয়োজন, যেখানে বঞ্চিত মানুষকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকর দেয়ার জন্য ডিজাইন করা হবে বা সাজানো হবে। এই সিস্টেমের কেন্দ্রে থাকবে ক্ষুদ্রঋণ। বর্তমান বিশ্বে শুধু এক রকম ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে। তারা শুধু লাভকে সর্বোচ্চ করার চেষ্টায় মত্ত। নতুন অর্থনীতির ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেমে আধিপত্য থাকতে হবে সামাজিক বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানের। যার ভিত্তি হবে ব্যক্তিগত লাভ শূন্য।
প্রশ্ন: করোনাভাইরাস সঙ্কটে গ্রামীণ ব্যাংক কিভাবে কাজ করছে এবং করোনা-পরবর্তী সময়ে কিভাবে কাজ করবে?
উত্তর: গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক এর ঋণ গ্রহীতারা। সুসময়ে এবং দুঃসময়ে এসব ঋণগ্রহীতার সর্বোত্তম স্বার্থ দেখছে এই ব্যাংক। গ্রামীণ ব্যাংক এবং এর ঋণ গ্রহীতাদের কাছে করোনা সঙ্কট হলো অন্য আরেকটি সঙ্কটের মতো। তবে এটা বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের মতো নয়, যা বাড়িঘর, পশুপাখি, শষ্য, সব সম্পদ এমনকি শিশুদের পর্যন্ত কেড়ে নেয়।
আমরা আশা করি, দরিদ্রদের কাছে এই সঙ্কট সেইরকম হবে না। তারা জীবন সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হবেন। প্রতিটি দুর্যোগের পরে তারা পিছু হটেন না। বিশেষ করে বিপর্যয়গুলো যখন ঘন ঘন আসে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় শুধু ঘন ঘনই আসে না, প্রতিবার তা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।