ঢাকা: জাতির গৌরব ও গর্বের প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিন আজ। ৯৯ বছর পূর্ণ করে আজ এ বিশ্ববিদ্যালয় পা রাখছে শতবর্ষে। স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা রাখা বিশ্বের অনন্য এই বিদ্যাপীঠ স্বীকৃত ‘জাতির বাতিঘর’ হিসেবে। শুধু শিক্ষা ও গবেষণায়ই নয়, জাতীয় প্রয়োজনের ক্রান্তিলগ্নে জাগরণের ভিত্তিভূমি হিসেবে কাজ করেছে এ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
১৯২১ সালের ১ জুলাই, আজকের এই দিনে পূর্ববাংলায় জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল এ বিদ্যাপীঠ। সেই থেকে দিনটি পালিত হয়ে আসছে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ হিসেবে। বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য- ‘শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।’
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। তার তিন দিন আগে ভাইসরয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়েছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ির নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং অন্যান্য নেতা। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভা পাস করে ‘দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নং-১৩) ১৯২০’। ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই। প্রথিতযশা শিক্ষাবিদের পদচারণায় ধন্য এ বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন। প্রতিষ্ঠালগ্নে এখানে শিক্ষক হিসেবে ছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এফ সি টার্নার, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, জিএইচ ল্যাংলি, হরিদাস ভট্টাচার্য, ডব্লিএ জেনকিন্স, রমেশচন্দ্র মজুমদার, এএফ রহমান, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, আশির দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা অগ্রগামী ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ছাত্রছাত্রী শহীদ হন।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩টি অনুষদ, ১৩টি ইনস্টিটিউট, ৮৪টি বিভাগ, ৬০টি ব্যুরো ও গবেষণা কেন্দ্র এবং ছাত্রছাত্রীদের ১৯টি আবাসিক হল, ৪টি হোস্টেল ও ১৩৮টি উপাদানকল্প কলেজ ও ইনস্টিটিউট রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৪৬,১৫০ জন; পাঠদান ও গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ২,০০৮ জন শিক্ষক। চলতি বছর মুজিববর্ষ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড লিবার্টি’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীন বাংলাদেশ। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জাতির প্রত্যাশা অনেক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকৃত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক
ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান-এই দুই স্থান থেকে লড়াই করেছে। এই লড়াইয়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও এর সূত্রপাত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাক্ষেত্রে যতটা অবদান রাখতে পারত, তা পারেনি। এই সমস্যার সমাধান করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও প্রকাশনা বাড়াতে হবে, শিক্ষার মান উন্নত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
দিবসটি উপলক্ষে উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান শুভেচ্ছা বাণী দিয়েছেন। এতে তিনি বলেন, ২০২১ সালে আমাদের অস্তিত্বপ্রতিম এই প্রতিষ্ঠান শতবর্ষপূর্তি উদযাপন করবে। দেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীও একই বছর উদযাপিত হবে। তাই বছরটি হবে আমাদের জন্য এক বিশেষ মর্যাদা, সম্মান, আবেগ, অনুভূতির সংশ্নেষে গৌরবদীপ্ত ও স্মৃতি-ভাবুকতার বছর। তিনি বলেন, নভেল করোনাভাইরাসের অতিসংক্রমণের কারণে বাংলাদেশও গভীর সংকটময় মুহূর্ত অতিক্রম করছে। আশার কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যরা দুর্যোগ মোকাবিলায় মানবিক সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন।
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে বছরব্যাপী নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ. কে. আজাদ বলেন, জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকীতে এবার এই দিবস পালিত হচ্ছে, এটি আমাদের জন্য আনন্দের। তিনি বলেন, এক সময় বিশ্বের সেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। কিন্তু ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে এখন এটি হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় গিয়ে ঠেকেছে। শতবর্ষে এসে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নত করতে হবে। গবেষণার মান বাড়াতে হবে। তাহলে আবারও প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের সুনাম ফিরিয়ে আনা যাবে। এ. কে. আজাদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র মেডিকেল সেন্টারটিতে সুযোগ-সুবিধা অপ্রতুল। উন্নতমানের করতে হবে এটিকে। ষাটের দশকের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে বর্তমানে প্রচুর শিক্ষার্থীর পড়ার মতো জায়গা হয় না। তাই একটি বহুতলবিশিষ্ট ডিজিটাল লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব রঞ্জন কর্মকার বলেন, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হবে ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন। সকাল ১০টায় সিনেট ভবনের সামনে জাতীয় পতাকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা উত্তোলনের সময় অ্যালামনাইয়ের সদস্যরা উপস্থিত থাকবেন। এরপর আলোচনা অনুষ্ঠানে অ্যালামনাইয়ের সভাপতি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন এ. কে. আজাদ। শতবর্ষ উপলক্ষে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের বছরব্যাপী পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়ে মহাসচিব বলেন, করোনাভাইসের কারণে এই প্রোগ্রামগুলো এখনই ঘোষণা করা যাচ্ছে না। তবে এর মধ্যে বড় উদ্যোগ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে একটি প্রকাশনা ও ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশন করা হবে। দ্বিতীয় পরিকল্পনা হলো, বিভিন্ন বিভাগ ও হল অ্যালামনাইকে নিয়ে শতবর্ষের প্রতিমাসে অন্তত একটা করে প্রোগ্রাম করা। তৃতীয় পরিকল্পনা হলো, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা অ্যালামনাইদের যুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং দেশের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার চিত্র সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচি : করোনা পরিস্থিতিতে স্বল্প পরিসরে দিবসটি উদযাপিত হবে। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে গৃহীত সংক্ষিপ্ত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে : আজ সকাল ১০টায় নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন প্রাঙ্গণে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা, বিশ্ববিদ্যালয় পতাকা উত্তোলন ও বেলুন উড়ানো এবং সকাল ১১টায় অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনলাইন ভার্চুয়াল মিটিং প্ল্যাটফর্ম জুমের মাধ্যমে আলোচনা সভা।
আলোচনা সভায় জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম সংযুক্ত হয়ে ‘শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় :আন্দোলন ও সংগ্রাম শীর্ষক মূল বক্তব্য দেবেন। এ ছাড়া, এই অনলাইন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন), উপ-উপাচার্য (শিক্ষা), কোষাধ্যক্ষ, প্রাক্তন দু’জন উপাচার্য, দু’জন ডিন, দু’জন প্রভোস্ট, একজন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট, ঢাবি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং ঢাবি শিক্ষক সমিতিসহ অন্যান্য সমিতির পক্ষ থেকে নেতারা সংযুক্ত হবেন।