চট্টগ্রাম: উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসার আমৃত্যু মুহতামিম বা পরিচালক শাইখুল হাদিস আল্লামা শাহ আহমদ শফীই। বুধবার সকাল ১০টায় শুরু হওয়া দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসায় মজলিসে শূরার বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত এসেছে।
সেই সাথে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এসেছে। সেগুলো হচ্ছে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী মাদ্রাসার সহকারী মুহতামিমের পদ থেকে অব্যাহতি এবং মাদরাসার সহকারী মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন আল্লামা শেখ আহমদ।
হাটহাজারী ওলামা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও হেফাজত নেতা মাওলানা জাকারিয়া নোমান ফয়েজী বুধবার বিকেলে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, বৈঠকে দারুল উলূম হাটহাজারীর ১১ জন শূরা সদস্যের উপস্থিতিতে বিকাল তিনটা পর্যন্ত চলা বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়।
সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, আল্লামা আব্দুল কুদ্দুস, পরিচালক ও শাইখুল হাদীস, জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ মাদরাসা, ঢাকা। কো-চেয়ারম্যান, হাইয়াতুল উলয়া আল্লামা মুফতি নুরুল আমিন।
নায়েবে মুহতামিম ও শায়খুল হাদিস, ফরিদাবাদ মাদরাসা ও যুগ্ম-মহাসচিব, বেফাক। নুরুল ইসলাম জিহাদী, পরিচালক, মাখজানুল উলূম মাদরাসা খিলগাঁও ও সহসভাপতি, বেফাক। মাওলানা নোমান ফয়জী পরিচালক, আলজামিয়াতুল ইসলামিয়া হামিউচ্ছুন্নাহ মেখল, হাটহাজারী। মাওলানা সালাহউদ্দিন নানুপুরী পরিচালক, জামিয়া উবাইদিয়া নানুপুর, ফটিকছড়ি। মাওলানা মাহমুদুল হাসান ফতেপুরী পরিচালক, ফতেপুর মাদরাসা, হাটহাজারী।
এর আগে দেশের বৃহৎ এই কওমি মাদ্রাসার পরিচালক ও হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর উত্তরসূরী কে হবেন তা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তাপ চলছিল দীর্ঘদিন ধরে। এদের একটি পক্ষ হচ্ছে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর। অপরটি হচ্ছে আল্লামা শাহ আহমদ শফীর অনুসারী। তবে এই উত্তাপ প্রশমনে বুধবার সকালে হাটহাজারী মাদ্রাসায় মজলিসে শূরা বৈঠক বসে।
হাটহাজারী ওলামা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও হেফাজত নেতা মাওলানা জাকারিয়া নোমান ফয়েজী বলেন, হাটহাজারী মাদ্রাসার বর্তমান মহাপরিচালক ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী সম্প্রতি কয়েক মাস ধরে বেশ কয়েক দফা অসুস্থ হয়ে চট্টগ্রাম ও ঢাকার বেশ কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। সর্বশেষ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে এক সপ্তাহ চিকিৎসা নেন তিনি। গত সোমবার (১৫ জুন) সুস্থ হয়ে মাদ্রাসায় ফিরেই তিনি শূরা কমিটির বৈঠক আহবান করেন।
এর কারণ হিসেবে আল্লামা আহমদ শফী যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তখন আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ঘোষণা করা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। তবে এ সময় এর বিরোধিতা করে আরেকটি পক্ষ পরিচালক পদে তাদের পছন্দের লোককে বসানোর চেষ্টা শুরু করে।
এ জন্য মাদ্রাসার বেশ কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষকের নামও প্রস্তাব করা হয়। ফলে মাদ্রাসার পরিচালকের পদ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়। এ নিয়ে দুই পক্ষ পরষ্পর মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও লেখালেখি করছে দু‘পক্ষ। দু‘পক্ষের উত্তেজনা এড়াতে আল্লামা আহমদ শাহ শফী বৈঠকের আহ্বান করেন।
বৈঠকে মাদ্রাসার শূরা কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশের কওমি মাদ্রাসা, ইসলামী দলগুলোর নেতাকর্মীদের ব্যাপক কৌতূহল চলছে। চলমান মজলিসে শূরার এ বৈঠক থেকে মাদ্রাসার মহাপরিচালক হিসেবে কারো নাম ঘোষণা আসতে পারে এমনটা মনে করছেন অনেকে। তবে বৈঠক শেষে মাদ্রাসার মূরা মজলিস থেকে এই তিন সিদ্ধান্ত আসে।
সূত্রমতে, হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক তিনিই হবেন পদাধিকারবলে যিনি অন্তত দুই শতাধিক মাদ্রাসার মুরব্বি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নেতৃত্ব পেতে পারেন হেফাজতে ইসলামের মতো দেশের সর্ববৃহৎ অরাজনৈতিক সংগঠনেরও। সে হিসেবে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব হিসেবে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর নাম আসে বারবার। আবার অনেকের মুখে আল্লামা বাবুনগরী ছাড়াও মহাপরিচালক পদে হাটহাজারী মাদ্রাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস প্রবীণ আলেম মাওলানা শেখ আহমদ ও সাবেক মুহতামিম মাওলানা আব্দুল ওয়াহাবের ছেলে মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা আহমদ দীদার কাসেমীসহ আরও দুয়েকজনের নামও শোনা যাচ্ছে। তবে তাদের ভাষ্য, আমরা মজলিসে শূরার সিদ্ধান্তই মেনে নেব।
এদিকে শূরা বৈঠক তথা মাদ্রাসার শীর্ষ পদে শাহ আহমদ শফীর উত্তরসূরি কে হবেন, তা নিয়ে তৎপরতায় প্রকাশ্যে আসা দু‘পক্ষের দ্বন্দ্বে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে এমন আশংকায় হাটহাজারী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পুলিশের অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন ছিল।
হাটাহাজরী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাসুদ আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, মাদ্রাসার শূরা বৈঠক তথা মহাপরিচালকের পদ নিয়ে যাতে কোনো পক্ষ আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে না পারে সে ব্যাপারে আমরা বেশ তৎপর।
প্রসঙ্গত, উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা। প্রায় ১২০ বছর ধরে দেওবন্দের পাঠ্যসূচিতে পরিচালিত হয়ে আসা বন্দরনগরী চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত দেশের মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে এটি সর্বপ্রাচীন ও বৃহৎ কওমি মাদ্রাসা।
বর্তমানে এ মাদ্রাসার মহাপরিচালকের (মুহতামিম) দায়িত্ব পালন করছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী। যিনি কওমি মাদ্রাসার সমন্বিত বোর্ড আল হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ (হাইয়াতুল উলয়া) ও কওমী মাদ্রাসা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ারও (বেফাক) সভাপতি।