ঢাকা: দূরের শহরে বাবা। গ্রামে অপেক্ষায় থাকে ছোট্ট শিশুটি। বাবা আসবেন। কর্মব্যস্ত বাবারও মন কাঁদে। কিন্তু যেতে পারেন না। জামা-কাপড় কিনে পাঠিয়ে দেন। মায়ের ফোনে শিশুটি কথা বলে বাবার সঙ্গে। ছুড়ে ফেলে দেয় জামা-কাপড়।
বলে, বাবা তুমি আসো। চোখ ভিজে ওঠে বাবারও। এমন থিমের একটি বিজ্ঞাপন হয়তো আপনি খেয়াল করে থাকবেন। ধর্মীয় উৎসবের বাইরেও বহু বছর ধরে ঈদ এমনই এক আবেগের নাম। মানুষ তার সবটুকু চেষ্টা করে প্রিয়জনের হাতে তুলে দেয় উপহার। পিতা ফিরে যান সন্তানের কাছে, সন্তান বাবা-মায়ের কাছে। দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্বজনদের আবার দেখা হয়। বহুদিন পর দেখা হওয়া বন্ধুকে বুকে টেনে নেয় বন্ধু। ঈদগাহে তৈরি হয় মিলনমেলা। ছড়িয়ে পড়ে নতুন এক আত্মিক বন্ধন।
তবে এবারের ঈদ একেবারেই আলাদা। এমন ঈদ এ ভূমে আগে কোনো দিন আসেনি। আপনি ফেরিঘাটে হয়তো কিছু ভিড় দেখছেন। প্রাইভেট গাড়িসহ নানাভাবে কিছু লোক ঢাকা ছাড়ার চেষ্টা করছেন। শপিংমলেও টুকটাক ভিড় দেখা গেছে। কিন্তু অতীতের সঙ্গে এটাকে কিছুতেই মেলানো যাবে না। দেশের বড় বড় শপিংমলগুলো বন্ধ। দোকানপাটে লোকজনের উপস্থিতি একেবারেই সামান্য। কমলাপুর স্টেশনে আজ কোনো ভিড় নেই। অথচ গত বছর ঈদের আগের আজকের দিনটির কথা স্মরণ করুন। এদিন কমলাপুর স্টেশনে কত হাজার মানুষ ছিলেন। ট্র্রেনের ছাদে করে কত মানুষ ঢাকা ছেড়েছেন। সায়েদাবাদ, গাবতলী অথবা সদরঘাটে কত মানুষ ছিলেন। সে তুলনায় আজকের দিনে কত মানুষ আছেন। হ্যাঁ, অনেক মানুষ আগে থেকেই বাড়িতে অবস্থান করছেন।
করোনাভাইরাস শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীটাই বদলে দিয়েছে। দুনিয়ায় যুদ্ধ, বিগ্রহ, মহামারি নানা দুর্যোগ গেছে। কিন্তু মুসলিমদের এমন ঈদ পালনের অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয়নি। জামাতে ঈদের নামাজ আদায় করতে পারবেন না মুসলিমদের বড় অংশ। যারা আদায় করার সুযোগ পাবেন তাদেরও সামাজিক দূরত্ব মানতে হবে। বাংলাদেশে পরিস্থিতি অবশ্য আরো কঠিন। আর্থিক কষ্টে রয়েছেন কয়েক কোটি মানুষ। করোনা আর লকডাউনের প্রথম আঘাত আসে খেটে খাওয়া মানুষের ওপর। তারা আয় হারিয়ে ফেলেন। মধ্যবিত্তের সঞ্চয় এরইমধ্যে শেষ। সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া বেশিরভাগ কর্মজীবী মানুষই ঠিকমতো বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। কারো পুরো মাসের বেতন হয়নি, কেউবা পেয়েছেন অর্ধেক বেতন। অনিশ্চিত এক ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে তাদের সামনে। ছোট্ট এক ভাইরাসের কাছে যেন ব্যর্থ হতে চলেছে মানুষের বহুদিনের সংগ্রাম। দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে মানুষগুলো হয়তো গরিবিবৃত্ত থেকে বের হয়েছিল। কিন্তু কালান্তক করোনা যেন আবার তাদের সেখানেই ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা নানা রকম হিসাবনিকাশ করছেন। কাটাকুটি করে তারা দেখাচ্ছেন কত লোক আবার নতুন করে দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাবে। এতো কাগজের হিসাব। জীবন তো আসলে আরো বহু কঠিন। আর জীবিকা বাঁচাতে গিয়ে বহুজীবন এরইমধ্যে বিপন্ন। গতকালই এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ ২৪ জনের মৃত্যুর কথা জানানো হয়েছে। হুহু করে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। সামনের দিনগুলো আরো খারাপ হবে এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন অনেকেই। কিন্তু কতটা খারাপ কেউ হয়তো তা জানেন না। সব ঠিক আছে পার্টির তৎপরতা আরো বড় বিপর্যয়ই ডেকে আনতে পারে।
গুটি কয়েক লোক ছাড়া বেশিরভাগ মানুষের পকেটের অবস্থা ভালো নয়। তারা স্বাভাবিক জীবন এরইমধ্যে হারিয়ে ফেলেছে। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি ও পরিবারের জীবনে নেমে আসছে বিপর্যয়। তাদের সঙ্গে অনেকসময় অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে। যেমন অমানবিক আচরণের শিকার হচ্ছেন রোগীরা। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরেও চিকিৎসা পাচ্ছেন না বহু রোগী। এম্বুলেন্সেই মারা যাচ্ছেন কেউ কেউ। এমনই এক মানবিক বিপর্যয়ের সময় মানুষ পালন করতে যাচ্ছে এবারের ঈদ। যখন মানুষ আগের মতো একে অন্যের কাছাকাছি যেতে পারবে না, পারবে না কোলাকুলি করতে। একের বাড়ি অন্যের যাওয়াও থাকবে নিয়ন্ত্রিত। বহু মানুষকে বাড়িতে বা হাসপাতালে ঈদের দিনও চিকিৎসা নিতে দেখা যাবে। একদল ব্যতিক্রমী চিকিৎসক সেদিনও রোগীদের সেবা দিয়ে যাবেন। দুঃসহ এক পরিস্থিতিতে পালিত হবে এবারের ঈদ। সবার প্রার্থনা এমন ঈদ যেন আর না আসে।