রাতুল মন্ডল নিজস্ব প্রতিনিধি: কালা ভাই এটা জন্মের পর দেয়া মা বাবার নাম। ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রতিটি ইট পাথরের সাথে যার রয়েছে নিবির সম্পর্ক। কলেজের প্রধান ফটকে হাসিমাখা মুখটাকে দর্শন করে কলেজ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। আর লেখা পড়া শেষ করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন কেউ কেউ। আর আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে লেখা পড়া করা এমন কোন শিক্ষার্থী নেই যে কালা ভাইয়ের সাথে মজার সম্পর্ক ছিলো না। এই প্রিয় মানুষটি আজও এই কলেজের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সাথে মিশে রয়েছেন নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ। শরিরে নেই আগের মত বল, যার কারণে লাটি হাতে আসেন কলেজ ক্যাম্পাসে।
কালা ভাইকে নিয়ে জীবন কর্ম তুলে ধরেছেন ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ও ছাত্র সংসদের ভিপি ও বর্তমান ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণত সম্পাদক এডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল, তিনি লিখেছেন কালা ভাইয়ের জীবন কর্ম। ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার মোহাম্মদ আলী ও রাবিয়া দম্পতির চতুর্থ সন্তান কালা ভাই। কালা ভাই প্রথম বিয়ে করেন আকলিমা নামের এক মেয়েকে। বিয়ের দুই বছরের মাথায় কালার সংসার আলোকিত করে আসে এক মেয়ে। মেয়ের বয়স দুই বছর হলে কালকে ছেড়ে চলে যায় স্ত্রী আকলিমা। শুরু হয় কালার কষ্টের ইতিহাস। তবুও একদিনের জন্য কলেজে আসতে ভুল করেনি কালা ভাই। মেয়ের বয়স তিনি বছরের মাথায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন কালা ভাই। শশুর বাড়ি কলেজ থেকে বেশি দূরে নয়।
আনন্দ মোহন কলেজের সাবেক ভিপি এডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল লিখেছেন, কলেজের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর কাছে কালা নামটি পরিচিত। একটা অসম্ভব সুন্দর মনের মানুষ সে। একটু প্রতিবন্ধী টাইপের। একটু জাগ্রত করলেই এই কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছে “কালা” নাম টি উদ্ভাসিত হতে বাধ্য। কলেজের এমন কোনো ছাত্রছাত্রী ছিলো না যার সাথে কালার কথা হয়নি দুই, চার, দশ,বিশ টাকা দেয়নি!
আমি যখন ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলাম কাজী জিএস ছিলো প্রায় সময় কালা আমাদের কাছে আসতো। কালার ইতিহাসটি অনেক বড় যা লেখা সম্ভব নয়।
একবার কালা আমাদের ইতিহাস বিভাগের সাথে পিকনিকে গিয়েছিলো মধুপুরে। আমরা যখন পিকনিক শেষ করে বাড়ি ফিরবো তখন দেখি কালা নেই মনিরুজ্জামান স্যার, মনিবুর রহমান স্যার ব্যস্ত হয়ে গেলেন কালার জন্য। সকল ছাত্রছাত্রী বাসে উঠে গেলো। আমি মাইক যোগে কালাকে ডাকতে লাগলাম, কিন্তু কালার কোনো খোঁজ মিলে নি। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমরা রওনা দিলাম কালা কে ছাড়াই পরের দিন সকালে আমি ছাত্র সংসদ অফিসে গিয়ে বসলাম দেখি কালা হাঁটতে হাঁটতে আমার অফিসে প্রবেশ করে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো নেতা আমারে থইয়া আইসো কেয়া??? আমি তাকে বল্লাম তুই কই গেসিলি? তরে না পায়া আমরা আয়া পরসিলাম।
কালা বল্ল – আমি জঙ্গলে ঘুমাইসিলাম উইঠা দেখি অন্ধকার কেউ নাই বন পুলিশ আমাকে ধইরা মেইনরোড দেখায়া দেয়। আমি সারা রাইত হাঁটতে হাঁটতে আয়া পরসি।
তখন আমি ক’টা টাকা দিয়ে কালা কে বিদায় করলাম। এইভাবেই কালা সকলের সাথে চলতো ফিরতো থাকতো। একটা লাঠি কালার হাতে সকল সময় থাকতো নতুন ছাত্র ছাত্রীরা এসে প্রথমে কালা কে দেখে ভয় পেতো পরে আর এই ভীতি থাকতো না পরে অনেকেই কালা কে নিয়ে মজা করতো।
কলেজ থেকে বেরিয়ে আসার পর যখন বিয়ে করলাম একদিন কলেজে গেলাম একটি অনুষ্ঠানে আমার বউ কে নিয়ে গেইটেই কালার সাথে দেখা। কালা বলেছিলো –
কই যাও? তুৃমার বউ রে ত চিনছি সে মিল্কী আপাদের লগে থাকতো। মিল্কী আমার বউ এর বান্ধবী ছিলো। এই কালার সাথে এই কলেজের ধুলো মাটি কণা লাল ইটের গাঁথুনি তারপর শহীদ মিনার বোটানিক্যাল গার্ডেন বাংলা বিভাগের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কড়ই তলায় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মিটিং মিছিল হিন্দু হোস্টেল, ডিগ্রী হোস্টেল, ইন্টার হোস্টেল এবং বড় পুকুরের পাঁকা ঘাটলা এই সব কিছুর সাথে কালার সম্পর্ক ছিলো। এসব জায়গায় কালা কে পাওয়া যেতো।
অনেক ছাত্রছাত্রীর জন্য কালা ছিলো অপরিহার্য একটি বিষয়। কালা কে দেখে অনেকেই মায়া করতো। শিক্ষক মন্ডলীরা কালা কে স্নেহের চোখে দেখতো এবং প্রশ্রয়ও দিতো। আনন্দ মোহন কলেজের ৭৫ থেকে ৯০ দীর্ঘ সময়ের এক ছাত্র আমি। খুব সম্ভবত ১৯৮৫ সালে কালা কে প্রথম আমি কলেজ চত্বরে দেখি। তারপর দেখেছি কালা কলেজ রোড থেকে কলেজে প্রবেশ করে ইতিহাস সেমিনার থেকে পদার্থ বিজ্ঞান এইভাবে বাংলা, হিসাববিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, অর্থনীতি সবগুলো সেমিনারে ঘুরে বেড়াতো কালা। সবাই মজা করতো কালা কে নিয়ে । একসময় আমি কলেজ থেকে চলে এলাম কালা রয়েই গেলো। বছরের পর বছর কেটে গেছে এখনো কালা কলেজে আছে। কলেজে অস্থায়ী ভিত্তিতে কালার চাকরী হয়েছে। কালা এখন কলেজের গার্ড। ১৫০০০ টাকা বেতন পায়। এখন কালা খুব দূর্বল কষ্ট করে হাঁটে।
কালার চার ভাই ছিলো। কালা ছোটো বেলা হাড়িয়ে গিয়েছিলো। অনেক দিন পর কালা এই কলেজ রোডে ফিরে এসেছিলো। বাবা মা না থাকায় বাড়িতে কালার আশ্রয় হয়নি। কালার অন্যান্য ভাই রা ব্যাংকে চাকরি করতো। জানা গেছে একজন অগ্রণী ব্যাংক এর ব্যবস্থাপক হয়েছিলেন।
কালার জীবন কাহিনী টা অনেকটাই বৃদ্ধাশ্রম এর মানুষ এর মতো। এই এলাকায় কালার একজন ভাতিজা আছে। কিন্তু এই ভাতিজা বা পরিবারের অন্য কেউ কালার কোনো খোঁজ খবর নেয় না। দীর্ঘ সময় পরিক্রমায় কালা এখন দূর্বল, চলা ফেরা ঠিকমতো করতে পারে না। এই কালার চোখের সামনেই ফারুখ আহমেদ খান, সুলতান উদ্দীন, আমি মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল, কাজী আজাদ জাহান শামীম, গোলাম ফেরদৌস জিলু, মাসুদ আহমেদ তান্না, সাজ্জাদ হোসেন শাহীন, মফিজুন্নুর খোকা, মোস্তাক আহমেদ রুহী, মাহবুব জাহান শাহীন, আমকসুর ভিপি জিএস হিসেবে বেড়িয়ে এসেছি। সনামধন্য এমদাদুল হক মিল্লাত, ওয়াহাব আকন্দ, নজরুল ইসলাম চুন্নু, এম. এ. কুদ্দুস, শওকত জাহান মুকুল সহ অনেক সনামধন্য ব্যক্তিরা কালার চোখে চোখে বড় হয়েছে। হাজারো আমলা, হাজারো ডাক্তার,হাজারো ইঞ্জনিয়ার, হাজারো আইনজীবী, হাজারো শিক্ষক,বহু সাংবাদিক, হাজারো সেনা পুলিশ এবং ব্যবসায়ী এই কালার চোখের সামনেই প্রতিষ্ঠ