ঢামেকের করোনা ইউনিটে চিকিৎসকসহ একদিনেই মারা গেল ২৮ জন

Slider জাতীয় ঢাকা বিচিত্র সারাদেশ


ঢাকা: ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে গত ২৪ ঘণ্টায় নর্দান মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল ডা: আনিসুর রহমানসহ ২৮ জন মারা গেছেন। মেডিক্যাল সূত্র বলছে, মৃতদের মধ্যে এক নারীসহ চারজনের করোনাভাইরাস পজিটিভ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বাকিরা করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। গত রোববার বিকেল থেকে গতকাল সোমবার বিকেল পর্যন্ত করোনা ইউনিটে এ ২৮ জনের মৃত্যু হয়।

এ দিকে গত ২ মে থেকে শুরু করা করোনা ইউনিটে এ পর্যন্ত ৮৯ জন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ১৭ জন করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। বাকিরা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন বলে মেডিক্যাল সূত্রে জানা গেছে। এ দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে চিকিৎসা নিয়ে নানান অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের যে ভাবে চিকিৎসা বা সেবা দেয়া দরকার তার ছিটে ফোঁটাও নেই করোনা ইউনিটে।

সংশ্লিষ্ট বিভাগের ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দায়সারাভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে রোগী ও তাদের আত্মীয়স্বজনরা অভিযোগ করেছেন। ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হচ্ছে রোগী ও তার স্বজনদের। সবখানেই অব্যবস্থাপনার মধ্যে দিয়ে চলছে ঢাকা মেডিক্যালের করোনা ইউনিট।

সোমবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক আলাউদ্দিন আল আজাদ বলেন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে করোনাভাইরাস পজিটিভ পাওয়া গেছে তিনজন পুরুষের এবং এক নারীর। বাকিরা করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। গত ২ মে থেকে শুরু করা করোনা ইউনিটে গতকাল সোমবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত এই হাসপাতালে নারী ও পুরুষ মিলে ৮৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে ১৭ জন করোনা আক্রান্ত।

তিনি আরো বলেন, যারা করোনাভাইরাসে উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ওই লাশগুলো তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আর যারা করোনা পজিটিভে মারা গেছেন সেই সব লাশ পর্যায়ক্রমে তাদের আত্মীয়স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে।

এ দিকে করোনা ইউনিটের অনিয়ম নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মেডিক্যালের করোনা ইউনিটে কর্মরত একজন নার্স ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এই ইউনিটে কোনো নিয়ম শৃঙ্খলা নেই। যার যা মনে ধরছে সে সেটাই করছে। কেউ কারো কথা শুনছে না। অনেক জনবল সঙ্কট নিয়ে চলছে এই ইউনিট। সব জায়গাতে অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনা

তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন, করোনা আক্রান্ত বা উপসর্গ নিয়ে যে সব রোগী মারা যাচ্ছেন, সেই লাশ নিয়ে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড মাস্টার, কর্মচারী ও বহিরাগত অ্যাম্বুলেন্স চালকরা মিলে তাদের আত্মীয়স্বজনদের সাথে বাণিজ্য করছে। এ দিকে ঢাকা মেডিক্যালের আরেক জন ওয়ার্ড মাস্টার বলেন, করোনা ইউনিটে ১০ দিনে ৮৯ জন রোগী মারা গেছেন। অন্য সময় ৬ মাসেও এত রোগী মারা যায়নি। সেখানে কী ধরনের চিকিৎসা হচ্ছে একমাত্র আল্লাহ পাকই জানেন!

এ দিকে আব্দুল্লাহ আল মামুন সময়ের আলো পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার তিনি বলেন, বেশ কয়েকদিন ধরে জ্বর-সর্দি-কাশিতে ভুগছেন। কোনোমতেই কমছে না তার অসুখ। করোনাভাইরাস উপসর্গ নিয়ে গত শনিবার বেলা ১১টার দিকে মামুন যান ঢাকা মেডিক্যালে করোনা ইউনিটে ভর্তি হওয়ার জন্য। সেখানে গিয়ে তার নতুন অভিজ্ঞতা হলো। তিনি দেখলেন, করোনা ইউনিটে রোগীরা এতটাই অবহেলিত যে, যা তার কল্পনাতেও আসেনি। একপর্যায়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, যদি তিনি মরেও যান এরপরও এ হাসপাতালে থাকবেন না। সিদ্ধান্ত মোতাবেক সেদিন তিনি চলে আসেন হাসপাতাল থেকে বাসায়। বাসায় এসে ঢামেকের করোনা ইউনিটের পরিস্থিতি নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তার অভিজ্ঞতার বিষয়টি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো :

‘আসসালামু আলাইকুম। জানি সবাই ভালো আছেন। আমি হাসপাতালে যাওয়ার পর থেকে আপনারা আমার সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রেখেছেন এ জন্য কৃতজ্ঞ। তবে সত্যি বলতে কী, এমন অভিজ্ঞতা হবে জানলে বাসায় মরে যেতাম তবুও হাসপাতালে যেতাম না। হাসপাতালে যাওয়ার পর ওয়ার্ড মাস্টার রিয়াজ ভাইয়ের কাছে পরিচয় দেয়ার পর উনি মোটামুটি ভর্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন কিন্তু ভর্তির সামগ্রিক কাজ শেষ হতে বিকেল সাড়ে ৩টা বেজে যায়।

সাড়ে ৩টা বাজে এ দরজা ও দরজা হয়ে তিন তলায় পাঠালেন। তিন তলায় যাওয়ার পর বলা হলো চিকিৎসকের কাছে গিয়ে ফাইল দেখিয়ে নিয়ে আসতে। পরে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে ঘণ্টাখানেক লাইনে দাঁড়িয়ে ফাইল দেখালাম। এরপরে আসলাম আবার নার্সের কাছে। আমি কোন রুমে থাকব সেটা জিজ্ঞেস করতে নার্স একটি রুম দেখিয়ে বললেন একটা বেডে গিয়ে থাকতে কিন্তু সেই রুমটিতে যাওয়ার পর দেখি কোনো বেড ফাঁকা নেই। আমি আবার এসে নার্সকে বিষয়টি জানালাম। নার্স আমাকে বললেন কিছুক্ষণ পর বেড ফাঁকা হবে। অর্থাৎ, ওই রুমে ১০ থেকে ১২টি বেড আছে, কিছুক্ষণের মধ্যে দুই একজন রোগী মারা যাবেন তখন বেড ফাঁকা হবে। নার্সের কথা সত্যি হতে বেশি সময় লাগেনি। আমি আধা ঘণ্টার মতো বাইরে এ দরজায় ও দরজায় ওয়েট করতে করতে দুইজন মারা যান। তখন নার্স আমাকে বলেন, ওই যে দুইজন মারা গেছেন তাদের কোনো একজনের বেডে গিয়ে ওঠেন। সবচাইতে অবাক করার বিষয় হলো, একটি বেডে প্রস্রাব করে রেখেছে এবং সেখানে আজকের মধ্যে কোনো চাদর দেয়া হবে না। আরেকটি বেডের অবস্থাও একই। সেখানেও কোনো চাদর দেয়া হবে না। আমাকে এভাবেই থাকতে হবে।

আগামীকাল পরিষ্কার চাদর এলে আমাকে দেয়া হবে। এমনকি বেডগুলোতে কোনো জীবাণুনাশক কিছু ছেটানো হয়নি। তখন আমি নার্সকে বললাম, এই অবস্থায় কিভাবে ওই বেডে থাকব যেখানে চাদর পর্যন্ত নেই। তখন নার্সরা বললেন আমাদের কিছু করার নেই। চাদর না আসা পর্যন্ত আপনাকে দেয়া যাবে না। এভাবেই আজকে রাত থাকতে হবে। আমি শেষমেষ বাধ্য হয়ে প্র¯্রাবে ভেজা ওই বেডে না থেকে বাসায় ফিরে আসি। এমন বাস্তবতার মুখোমুখি আর কোনো সাংবাদিক ভাই হয়েছেন কি না আমি জানি না। আমরা অন্তত আর কোনো সাংবাদিককে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তির জন্য পরামর্শ না দেই। সবার জন্য শুভকামনা। আরো অনেক কিছু লেখার ছিল। সারাদিন শরীরের উপর অনেক ধকল যাওয়ায় আর পারলাম না। ভবিষ্যতে অনেক বিস্তারিত লিখব।

এ বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটের নার্স ইনচার্জ দিপুর সাথে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টি শুনে তিনি জানান, এটাতো খুবই দুঃখজনক ঘটনা। বিষয়টি কারা করেছে কেন করেছে এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিছনার চাদরসহ অন্যান্য সবকিছুই দেয়া আছে তাদের কাছে।

বিষয়টি ঢাকা মেডিক্যালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিনকে জানানো হলে তিনি ওই হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের নার্স ইনচার্জ দিপুকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। এরপর আর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। এভাবে চলে দিনে পর দিন মসের পর মাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *