ডেস্ক: চলতি মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ বা পিকটাইম হিসেবে দেখা যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ সময়ে সারা দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যেমন বাড়বে তেমনি বাড়বে মৃত্যুর সংখ্যাও। এরই মধ্যেই সাধারণ ছুটি শিথিল, পোশাক কারখানা, রেস্টুরেন্ট খুলে দেওয়া এবং প্রশাসনের ঢিলেঢালাভাবের কারণে পাড়া-মহল্লার দোকানপাট প্রতিদিন যে হারে খুলছে তাতে সংক্রমণ সংখ্যা নিয়ে শঙ্কিত বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মে মাস বাংলাদেশের জন্য ভয়ঙ্কর হলেও জুন মাস থেকেই রোগীর সংখ্যা কমতে শুরু করতে পারে।
বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। সে মাসে মোট শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ৫১ জন। এপ্রিলে শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় সাত হাজার ৬১৬ জনে। গত কয়েক দিনে প্রতিদিনই নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে চার-পাঁচশ বা তারও বেশি। মূলত সারা দেশে যত বেশি পরীক্ষা হচ্ছে তত বেশি রোগীও শনাক্ত হচ্ছে। আগামী ১৪ দিন কঠিন সময়। তাই ভীষণ সতর্কতা নিয়ে পরিকল্পিতভাবে পার করতে হবে। যদি সেটা না হয় তাহলে সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যু এবং রোগী দুটোই দেখা যাবে মে মাসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, মানুষ লকডাউন মানছে না। ঢাকা শহরের সংক্রমিত মানুষের হার এর সঙ্গে মেলালেই সেটা বোঝা যায়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে জানান, আগামী ৩১ মে পর্যন্ত ৪৮ হাজার থেকে ৫০ হাজার মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন এবং মারা যেতে পারেন ৮০০ থেকে এক হাজার মানুষ। গত ২১ এপ্রিল করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও প্রতিকারে গৃহীত কার্যক্রম পর্যালোচনা এবং পরবর্তী করণীয় বিষয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সভায় তিনি এ তথ্য জানান।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, কোনো মডেলিংই প্রকৃতপক্ষে বাস্তবের সঙ্গে মেলে না। কিন্তু মডেলিং করা হয় প্রস্তুতিতে সাহায্য করার জন্য। তবে মে মাসের মাঝামাঝি করোনার পিকটাইম হিসেবে দেখা দিতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বেনজির আহমেদ বলেন, বর্তমানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ব্যবস্থা রয়েছে সেটা যথেষ্ট নয়। লকডাউন যদি ধীরে ধীরে তুলে নেওয়া হয় তাহলে সংক্রমণ বাড়বে এবং বাড়তেই থাকবে। পুরো মে মাসেই সংক্রমণ হতেই থাকবে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরুতে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) কভিড-১৯-এর নমুনা পরীক্ষা করা হলেও বর্তমানে দেশে পরীক্ষা হচ্ছে ২৮টি ল্যাবরেটরিতে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ১২টি ও ঢাকার বাইরে ১৬টি প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি তিনটি হাসপাতালকে করোনা পরীক্ষার জন্য অনুমতি দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। যদিও এ হাসপাতালগুলো কেবল তাদের ভর্তি হওয়া রোগীদের পরীক্ষা করাতে পারবে।
চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক আতিক আহসান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, মে মাস আমাদের জন্য ভালো কিছু আনবে না। খারাপ যা হতে পারে সেটা মে মাসের মধ্যেই দেখব। এর পরে ধীরে ধীরে রোগীর সংখ্যা কমতে শুরু করবে। তিনি বলেন, সারা দেশে রোগী ছড়িয়েছে এবং সবাইকে শনাক্ত করা যায়নি। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে রোগী বাড়বে এ কথা আগেই বলা হয়েছিল। সে অনুযায়ী মধ্য এপ্রিল থেকেই রোগী বাড়তে থাকে। আর অন্য দেশের ট্রেন্ড বলছে, রোগী বাড়তে শুরু করলে সেটা ৩০ দিন পর্যন্ত বেড়েই চলে। রোগীর সংখ্যা যখন ক্রমাগত বাড়ছে তখন দেশের সাধারণ ছুটি তুলে নিয়ে পোশাক কারখানা, দূরপাল্লার ট্রেন চলাচলের ভাবনা, রেস্টুরেন্ট খুলে দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, লকডাউন তুলে নেওয়ার ধাপ না মানা হলে বড় মূল্য দিতে হতে পারে। চীন প্রথমে ব্যবস্থা নেয়নি বলে পরে তাদের কঠোরতম ব্যবস্থায় যেতে হয়েছে। ইতালিকে আরও বেশি মূল্য দিতে হয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রকে আরও অনেক বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি কোথায় যাবে সেটা বলা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও লকডাউনের বিষয়ে যদি উদাসীনতা দেখানো হয়, তাহলে তার মূল্য কত বেশি দিতে হবে সেটা বলা মুশকিল এবং নিশ্চয়ই সেটা শঙ্কার বিষয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বেনজির আহমেদ বলেন, রোগী সংক্রমণ ঠেকানোর একমাত্র এবং কার্যকর পন্থা ছিল কঠোর লকডাউন, সেটা ঢাকার বাইরে এবং ঢাকার ভিতরেও। লকডাউন না তুলে নেওয়াই উচিত। কলকারখানা যেভাবে খুলে দেওয়া হচ্ছে সেখান থেকে সরে আসা উচিত। সাধারণ মানুষের কাছে সিগন্যাল যাচ্ছে, লকডাউন প্রত্যাহার করা হচ্ছে এবং বাইরে চলাচল করা যায়- এ ভাবনা অশনি সংকেত। এটা শঙ্কার নির্দেশনা দেয়। লকডাউন যদি খুলতেই হয় তাহলে পরিকল্পিতভাবে সেটা করতে হবে।