ঢাকা: করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশের খাদ্য উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তা অর্জন এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনার কারণে কৃষি তথা খাদ্য উৎপাদনে যাতে কোনো প্রভাব না পড়ে সে জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
দেশের কোথাও যাতে কোনো জমি অনাবাদি না থাকে সেদিকটা দেখার পাশাপাশি চলমান বোরো ধান, আলু, ভুট্টা, গমসহ বিভিন্ন কৃষি নিত্যপণের উচ্চফলন ও সঠিকভাবে সংগ্রহ এবং আসন্ন আউশ ও আমন আবাদকে নিয়ে একগুচ্ছ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কৃষি কর্মকর্তা, গবেষকসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রণালয়। চলমান করোনাভাইরাসের ছুটিকালীন সময়ে যাতে কৃষিপণ্য উৎপাদনে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে সে জন্য কৃষি যন্ত্রপাতির দোকানগুলো খোলা রাখা এবং তা পরিবহনের ব্যবস্থা করেছে। তবে কৃষি সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আর ১৫-২০ দিন পর থেকেই পুরোদমে শুরু হচ্ছে বোরো ধান কাটার মৌসুম। এবার বোরো আবাদ ভালো হয়েছে। কোনো ঝড়-ঝাপটা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ না এলে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তেমন কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। তবে এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ধান সঠিক সময়ে সংগ্রহ করা যাবে কি না সে বিষয়টি। কারণ করোনার কারণে মানুষের চলাচল সীমিত করা হয়েছে। সামনে আরো কঠিন পরিস্থিতি হলে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘর থেকে মাঠে নামাটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: নাসিরুজ্জামান নয়া দিগন্তকে বলেছেন, করোনাভাইরাসের এই কঠিন সময়ে আমরা কৃষিপণ্য উৎপাদনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। এ জন্য সবধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আশা করছি খাদ্য উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে এবং কৃষকও তাদের কৃষিপণ্যের সঠিক মূল্য পাবে।
সূত্রে জানা যায়, এবার সারাদেশে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৮ লাখ ৬৬ হাজার হেক্টর। আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে, রোপণ হয়েছে ৪ লাখ ৬৩ হাজার হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ শতাংশ বেশি জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। এদিকে ৪ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে ভুট্টা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৪৬ হাজার হেক্টর জমিতে। একইভাবে সূর্যমূখী আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ৬৮৭ হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছে ২ হাজার ৬৩৬ হেক্টর জমিতে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত কয়েক বছর ধরে মাঠ পর্যায়ে কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় এবার বোরো আবাদ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কিছুটা কম জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট আউশ, আমন ও বোরো মিলে প্রায় তিন কোটি ৮৭ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার বেশির ভাগই পূরণ করবে বোরো ধান। চলতি বছর প্রায় দুই কোটি চার লাখ ৩৬ হাজার টন বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, যা মোট উৎপাদন লক্ষ্যের ৫৩ শতাংশ। এ ছাড়া আমন এক কোটি ৫৩ লাখ ৫৮ হাজার ও আউশ ২৯ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা রয়েছে। গত বছর (২০১৮-১৯) দেশে মোট ধান উৎপাদন হয়েছিল তিন কোটি ৭৩ লাখ ৬৩ হাজার মেট্রিক টন।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, দেশে দানাদার (চাল-গম) খাদ্যশস্যের বার্ষিক চাহিদা প্রায় দুই কোটি ৭০ লাখ মেট্রিক টন। সে অনুসারে দৈনিক খাদ্যশস্যের চাহিদা প্রায় ৭৪ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ মাসে ২২ লাখ টনের কিছু বেশি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গত ১৬ মার্চ পর্যন্ত দেশে সরকারি পর্যায়ে খাদ্যশস্য মজুদের পরিমাণ ১৭ লাখ ৫১ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ১৪ লাখ ২৯ হাজার টন ও গম তিন লাখ ২২ হাজার টন। তবে সরকারি মজুদের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে বেসরকারি পর্যায়ে। এই অবস্থায় ফের খাদ্য শস্য কেনার ঘোষণা দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। চলতি মৌসুমে (২০২০ সাল) ৭৫ হাজার মেট্রিক টন গম, ৬ লাখ মেট্রিক টন বোরো ধান, ১০ লাখ মেট্রিক টন বোরো সিদ্ধ চাল এবং দেড় লাখ মেট্রিক টন আতপ চাল কেনার জন্য খাদ্য অধিদফতরের ডিজিকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আগামী ১৫ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এসব খাদ্যপণ্য কিনবে সরকার।
বোরো ধান সংগ্রহে চ্যালেঞ্জ : আর ৮-১০দিন পর থেকেই শুরু হচ্ছে বোরো মৌসুম। সারাদেশে এবার যে বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। কোনো ঝড়-ঝাপটা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ না এলে তা অর্জনে তেমন কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। জানা যায়, হাওরাঞ্চলে সবার আগে ধান কাটা শুরু হয়। এরপর উত্তরাঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চলে। দেশের যে পরিমাণ বোরো আবাদ হয়, এর বড় একটি অংশই আসে হাওরবেষ্টিত সাত জেলা (কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) থেকে। এবার হাওরের সাত জেলার বোরো আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে।
কৃষি সচিব মো: নাসিরুজ্জামান নয়া দিগন্তকে বলেন, হাওরে ধান কাটা কিছুটা শুরু হয়ে গেছে। তবে ব্যাপকভাবে কাটা শুরু হবে ১৪-১৫ এপ্রিল থেকে। তারা যেন সঠিকভাবে ধান কাটতে পারে সেদিকে নজর দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে হাওর থেকে ধান কেটে আনা। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ১০০ কোটি টাকা আমরা পেয়েছিলাম। সারাদেশের জন্য প্রায় ৮০০ এর মতো কম্বাইন হার্ভেস্টার (ধান কাটার মেশিন) কিনেছি। এর মধ্যে হাওরেই দেয়া হয়েছে ২০০টি। কারণ হাওরে দ্রুত ধান কাটা দরকার।
নাসিরুজ্জামান বলেন, (করোনার কারণে) এক জেলা থেকে আরেক জেলায় লেবাররা যেতে পারছে না। তো সেক্ষেত্রে আমরা মেশিন পাঠাচ্ছি। পাশাপাশি আমরা স্থানীয় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে যেসব শ্রমিক ওই এলাকায় যাবে তাদের চলাচল একটু শিথিল করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এই হাওর থেকে ২০ লাখ টন চাল আসে। এর মধ্যে হাওরের নিচের অংশ (নিচু এলাকা) থেকে ১০ লাখ টন চাল আসে। কৃষি সচিব বলেন, উঁচু এলাকা ডোবে না। কিন্তু ২২ এপ্রিলের পরেই হাওরের নিচু এলাকায় পানি চলে আসবে। তার আগেই ওই এলাকার ধান কেটে আনাটা মূল চ্যালেঞ্জ।
এদিকে দেশের করোনাভাইরাসজনিত রোগের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩১ দফা নির্দেশনা প্রদান করেছেন। এর মধ্যে কৃষি নিয়েও তার ৩টি নির্দেশনা রয়েছে। সেগুলো হলো- খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে, অধিক প্রকার ফসল উৎপাদন করতে হবে; খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যা যা করা দরকার করতে হবে কোনো জমি যেন পতিত না থাকে; নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও নিয়মিত বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া মনিটরিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং কৃষকরা নিয়মিত চাষাবাদ চালিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে সরকারি প্রণোদনা অব্যাহত থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় তার অধীনস্থ সকল দফতর ও সংস্থা প্রধানকে চিঠি দিয়েছে গত সোমবার।
এ বিষয়ে কৃষি সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। বিশেষ করে কোনো জমি যাতে অনাবাদি না থাকে সেদিকে বিশেষ নজর দেয়া হচ্ছে।
আউশ উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ : গত সোমবার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালককে আসন্ন আউশ মৌসুমে আউশ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (প্রশাসন-৫ অধিশাখা) কাজী আব্দুর রায়হান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, ‘চলতি বছরে আউশের লক্ষ্যমাত্রা ১৩ লাখ ২৬ হাজার হেক্টর নির্ধারণ করা হয়েছে। আউশ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই লক্ষ্যমাত্রা বা এরও অধিক অর্জন করতে হলে সঠিক সময়ে বীজতলা তৈরি, রোপণ, সেচসহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যথাযথ প্রস্তুতি সম্পন্ন করা প্রয়োজন।’
এ বিষয়ে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কিছু পরামর্শ তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো, ‘আউশ রোপণের আদর্শ সময় ১ মে থেকে সর্বোচ্চ ১৫ মে পর্যন্ত। তাই সময়মত রোপণের জন্য ১৫ এপ্রিলের পর (১৫-২৮ এপ্রিলের মধ্যে) বীজতলায় বীজ ফেলতে হবে এবং চারার বয়স যাতে ২০ দিনের বেশি না হয় (১৫-২০ দিন) সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সঠিক সময়ে রোপণের জন্য জমি তৈরির সময় প্রয়োজনে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।’
এমতাবস্থায় আউশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে যাবতীয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয় কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে।
কৃষি সচিব মো: নাসিরুজ্জামান নয়া দিগন্তকে বলেন, গত বছর ২৯ লাখ মেট্রিক টন আউশ ধানের চাল উৎপাদন হয়েছিল। এবার আমাদের লক্ষ্যমাত্রা আরো ৫ লাখ টন বেশি তথা ৩৪ লাখ টন।
অন্যদিকে গত সোমবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের সকল দফতর বা সংস্থা প্রধানকে চিঠি দিয়ে করোনাভাইসেজনিত উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কৃষি উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা প্রতিপালন করে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। বসতবাড়ির আঙিনাসহ সকল পতিত জমিতে শাকসবজি, ফলমূল ও অন্যান্য ফসলের চাষ করতে হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের মোট আয়তনের তিন ভাগের একভাগ উপকূল অঞ্চল। এই উপকূলীয় অঞ্চলের আবার ৫৩ ভাগই লবণাক্ত, শুষ্ক মৌসুমে এসব জমিতে লবণাক্ততার মাত্রা ক্রমেই বাড়তে থাকে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ৮ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমি পতিত থাকে বা কোনো কিছুর আবাদ হয় না। এসব জমিতে চাষাবাদের জন্য উচ্চফলনশীল ব্রি ধান৬৭ এবং উন্নত ফলনশীল গম, ডাল, ভুট্টা চাষ শুরু হয়েছে এবার। আশা করা হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের অনাবাদি থাকা এই জমি থেকে এবার অতিরিক্ত ফসল উৎপাদিত হবে।