ঢাকা: করোনা পরিস্থিতিতেও গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে ত্রাণ গ্রহণ ও ন্যায্য মূল্যের পণ্য কিনছেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা। এতে করে এই শ্রেণির মানুষেরা মারাত্বক করোনা ঝুঁকিতে রয়েছেন। অন্যান্য সময়ের মত করোনা পরিস্থিতিতে সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবি ন্যায্য মূল্য পণ্য বিক্রি করছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে ট্রাকে করে তেল, চিনি, পেঁয়াজ ও আটা বিক্রি করে। কমদামে এসব পণ্য ক্রয়ের জন্য দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের আগ্রহ বেশি থাকে। তাই এসব পণ্য কেনার জন্য তারা টিসিবির ট্র্যাক ঘিরে গাদাগাদি করে লাইন ধরে পণ্য কিনে। অনেকেই সেখানে লাইনে দাঁড়িয়ে আবার কেউবা হুড়োহুড়ি করে পণ্য কিনছেন। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে টিসিবির পণ্য বিক্রি সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
গত কয়েকদিন শহরের বিভিন্ন অলিগলি ঘুরে টিসিবির পণ্য বিক্রির বাস্তব চিত্র দেখা গেছে। ক্রেতাদের মধ্য যেমন সচেতনতা নাই ঠিক তেমনি যারা পণ্য বিক্রি করছেন তাদের মধ্যও সচেতনতার অভাব রয়েছে। সরজমিন বুধবার খিলগাঁও এলাকায় দেখা গেছে, টিসিবির একটি পণ্যর গাড়ি ঘিরে অন্তত শতাধিক মানুষের ভীড়। তাদের সবার হাতে পন্য বহণ করার ব্যাগ আছে। গাদাগাদি করে দাড়িয়ে আছেন লাইনে। কেউ কেউ লম্বা লাইন থাকায় বসে পড়েছেন। কিন্তু তাদের কারো মুখে যেমন মাস্ক নেই তেমনি হাতে কোনো গ্লাবস নেই। শাহাজাহানপুর এলাকার রিকশা চালত আরিফ মিয়ার স্ত্রী পেয়ারা বানু বলেন, ঘরে একটা মাস্ক আছে। তবে কাজে কর্মে থাকি তাই ব্যবহার করা হয়না। আর শুনেছি এই এলাকায় কেউ অসুস্থ হয় নাই। তাই অনেকেই মাস্ক ব্যবহার করছে না। মিন্টু মিয়া নামের দক্ষিন শাহাজাহানপুরের বাসিন্দা জানান, মাস্ক ব্যবহার করা ভালো। কিন্তু সবসময় সেটা মনে থাকে না। একইভাবে নায্য মূল্যের পণ্য কিনতে গিয়ে শহরের অনেক স্পটেই দরিদ্র শ্রেণির মানুষেরা নিয়ম কানুন না মেনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে পণ্য কিনছেন।
এদিকে শুধু ন্যায্য মূল্যের পণ্য কিনতে নয় বিভিন্ন সংগঠন, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ত্রাণ বিতরণেও সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা হচ্ছে না। দাতাদের পাশাপাশি ত্রাণ গ্রহিতারাও নিয়ম ভাঙছেন। মোটকথা অধিকাংশ স্থানে ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে। ত্রাণ বিতরণে পুলিশের সহযোগীতা নেয়ার কথা বলা হলেও দাতারা সেটি তোয়াক্কা করছেন না।
হোম কোয়ারেন্টিন বাস্তবায়ন করতে নিম্নবিত্ত ও কর্মহীন মানুষের ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার জন্য বলা হলেও বাস্তবে তেমনটি দেখা যায় না। এমনকি স্থানীয় প্রশাসনকে অবগত করা হয় না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছু দাতারা নিজেদের কার্যক্রমকে প্রচার করার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ দিতে চান না। এছাড়া সত্যিকারের অসহায়দের খোঁজ নিয়ে তালিকা তৈরি করা হয় না। এতেকরে অধিকাংশ অসহায় পরিবার ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার জন্য সমন্বয় প্রয়োজন। দলীয়, সামাজিক, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন সংগঠনের ত্রাণ সামগ্রী সমন্বয় করে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন বা সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বিতরণ করা হলে বিশৃঙ্খলা রোধ করা সম্ভব হবে। না হলে বিশৃঙ্খলা বা অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবেই। এ জন্য সরকারী উদ্যোগেই ত্রাণ বিতরণ কাঠামো তৈরি করতে হবে।
সরজমিন যা দেখা যায়, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষেরা প্রতিদিনই রাস্তার মোড়ে মোড়ে ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করে দলবেঁধে বসে থাকেন। কখনও তাদের কাঙ্খিত অপেক্ষা সফল হয় আবার কখনও হয়না। আজ বৃহস্পতিবারও শাহাজাহানপুরের আমতলায় অন্তত অর্ধশতাধিক স্বল্প আয়ের মানুষকে ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। পণ্যবাহী গাড়ি দেখলেই তারা দৌড় দিয়ে কাছে যাচ্ছেন। ত্রাণের গাড়ি না হওয়াতে আবার এসে বসে বসে অপেক্ষা করছেন। মাজেদা নামের ৫০ বছর বয়সী এক নারী বলেন, সকালে খিলগাঁও আর বিকালে এখানে বসে অপেক্ষা করি কখন ত্রান আসবে। কিন্তু সব দিন আসে না। যারা আসে তারা সীমিত ত্রাণ নিয়ে আসে। ১০০ জনের ত্রাণ নিয়ে আসলে অপেক্ষায় থাকে ২০০ জন। তাই গাড়ি আসলে কে যাবে সবার আগে এই প্রতিযোগীতা লেগে যায়। ধাক্কাধাক্কি হয় মারামারিও হয়। যাদের ধাক্কাধাক্কি করার সামর্থ্য আছে তারাই ত্রাণ পায়। সমবয়সী রহিম মিয়া বলেন, আমরা বয়স্ক লোক। ধাক্কাধাক্কি করতে পারি না তাই সবার আগে এসেও ত্রাণ পাই না। সিরিয়াল মেনে যদি দেয়া হতো তাহলে সবাই পেত। এখনতো যারা পাচ্ছে তারা সবসময়ই পাচ্ছে। আর যারা পাচ্ছে না তারা একেবারেই পাচ্ছে না।
এমন চিত্র শুধু শাহাজাহানপুরে নয়। খিলগাঁও, মুগদা, মালিবাগ, মগবাজার, মানিকনগর, শান্তিনগর, ফকিরাপুলসহ বিভিন্ন এলাকায় এমন চিত্র দেখা গেছে। সমন্বয় আর পরিকল্পনার অভাবে শহরের অধিকাংশ স্থানে ত্রাণ বিতরণে এমন বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে একদিকে যেমন সত্যিকারের অসহায়রা ত্রাণ পাচ্ছে না ঠিক তেমনি গাদাগাদি আর ধাক্কাধাক্কি করে সামাজিক দুরত্ব না মেনে করোনার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে তারা।