মনির হায়দার, নিউ ইয়র্ক: শোকে পাথর এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশিরা । রাত পোহাতেই প্রতিদিন একাধিক মৃত্যুসংবাদ। আগ্রাসী করোনা ভাইরাসের থাবায় প্রাণবায়ূ নিভে যাচ্ছে কারো চেনাজানা খুব কাছের মানুষের, কারো আত্মীয়-স্বজনের, কারো বা খোদ পরিবারেরই সদস্যের। বুধবার সকাল থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত মাত্র ২৪ ঘন্টায় মিলেছে আরও ১৯ বাংলাদেশির মৃত্যুসংবাদ। এ নিয়ে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে এখানে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দুনিয়া ছেড়েছেন সর্বমোট ৫৪ প্রবাসী। আক্রান্ত আছেন কয়েক শ’। তবে এরইমধ্যে অনেক প্রবাসী কভিড ১৯ এর সঙ্গে লড়াইয়ে সুস্থ হয়েও উঠেছেন। আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন কারো কারো অবস্থার উন্নতি হয়েছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার ৮২৬ জনে। মৃত্যু হয়েছে ৫ হাজার ১৪৪ ব্যাক্তির। একই সময়ে সর্বাধিক বাংলাদেশী অধ্যুষিত নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ৮৩ হাজার ৯০১ এবং মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ২১৯ জনের।
করোনা সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্ত নিউ ইয়র্ক নগরীতে এরইমধ্যে দু’টি বড় অস্থায়ী হাসপাতাল চালু হয়েছে। এর একটি ইউএস নেভি পরিচালিত এক হাজার শয্যার ভাসমান হাসপাতাল এবং অন্যটি নগরীর সর্ববৃহৎ কনভেনশন কমপ্লেক্স জ্যাকব জ্যাভিট সেন্টারের ফিল্ড হাসপাতাল। এরমধ্যে নগরীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বড় হাসপাতাল থেকে কভিড ১৯ ছাড়া অন্য রোগীদের ইউএস নেভির ভাসমান হাসপালটিতে স্থানান্তর করা হচ্ছে যাতে এসব হাসপাতালে আরও বেশি সংখ্যক করোনা ভাইরাস আক্রান্তকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়।
এদিকে গত মঙ্গলবার করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া নিউ ইয়র্ক রাজ্যের গভর্ণর অ্যান্ড্রু কুমোর ছোট ভাই সিএনএন এর প্রখ্যাত সাংবাদিক ক্রিস কুমো তাঁর বাড়িতে বসেই চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং একইসঙ্গে তাঁর নিয়মিত সাংবাদিকতার কাজও চালিয়ে যাচ্ছেন। অসুস্থ হওয়ার পরও গত দু’দিন তিনি সিএনএন এ সরাসরি সম্প্রচারিত হওয়া তাঁর জনপ্রিয় অনুষ্ঠান কুমো প্রাইম টাইম যথারীতি উপস্থাপনা করেছেন, তবে নিজের বাড়ির বেজমেন্টে বসে। নিজের ছোট ভাইয়ের অসুস্থতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে গভর্ণর কুমো সংবাদ সম্মেলনে কিছুটা আবেগাক্রান্ত হয়ে বলেন, করোনা ভাইরাস হচ্ছে এক নির্মোহ সমতা সৃষ্টিকারী। ধনী-গরীব, শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, ডেমোক্রেট-রিপাবলিকান কিংবা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার ওপরই সে হানা দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক বাংলাদেশি অধ্যুষিত নিউ ইয়র্কে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ষাট বা সত্তরোর্ধ বয়ষ্ক ব্যক্তিরা যেমন রয়েছেন তেমনি আছেন কম বয়েসী তরুনও। মধ্যে গত ২৪ ঘন্টায় মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে রয়েছেন চাঁদপুর ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা মোস্তাক আহমেদ, কোম্পানীগঞ্জ ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের প্রবীন সদস্য মোহাম্মদ ওয়াজিউল্লাহ খোকন,বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান, সাংবাদিক শাহ আহমদের দাদি সাহারা বেগম, মালেকুজ্জামান মানিক, শিপন মিয়া, আব্দুল মালেক খান, আফজাল আহমদ, মো: মহসিন, রাশেদা আক্তার বিউটি, আইয়ুব খান, সৈয়দা খাতুন, বদরুল হক আতিক, মহিকুজ্জামান, আব্দুর রহমান স্বপন, আব্দুর রউফ, রফিকউদ্দিন, জাফর আহমদ প্রমূখ। মৃতদের প্রায় সকলকেই সীমিত আকারের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় নিউজার্সির মার্লবোরো মুসলিম গোরস্থানে অথবা নিউ ইয়র্ক রাজ্যের লং আইল্যান্ডের ওয়াশিংটন মেমোরিয়াল সিমেটারিতে দাফন করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, এখানে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতদের মরদেহ হাসপাতাল থেকে ফিউনারেল হোম কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মুসলিম ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ফিউনারেল হোম মৃতদেহের গোসলসহ প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াকরণ শেষে তাদের ব্যবস্থাপনায় গোরস্থান পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। এরপর মৃতের আত্মীয়-স্বজন ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা সীমিত পরিসরে জানাযার মাধ্যমে মৃতদেহ দাফন করেন। মৃতদের গোসল, জানাযা ও দাফন নিয়ে এখানে কোনো ধরণের অনিশ্চয়তা বা নৈরাজ্য নেই।
এদিকে বাংলাদেশ সোসাইটি অব ইউএসএ’র সভাপতি কামাল আহমেদ, কমিউনিটির জনপ্রিয় মুখ বাংলাদেশ সোসাইটির যুগ্মসম্পাদক আজাদ বাকির, ইমাম মাওলানা ফায়েকউদ্দিন, স্টারলিং প্লেস বাংলাদেশ বিজনেস এসোসিয়েশনের নেতা গিয়াসউদ্দিন আহমেদসহ অনেকেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদের মধ্যে আজাদ বাকিরের অবস্থা খুবই নাজুক। তাঁকে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের সাহায্যে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।