ডেস্ক: কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারি হিসাবে ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। করোনায় এরই মধ্যে ২ লাখ ৪৭ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ১০ হাজার ৬২ জনের। আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগেও পৃথিবীতে একই ধরণের মহামারিতে কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। করোনা মহামারি শুরু হয়েছে ২০১৯ সালের শেষের দিকে। আগের মহামারিটি আঘাত হেনেছিল ১৯১৮-১৯১৯ সালে। সে সময়ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শাসকগোষ্ঠী স্প্যানিশ ফ্লুর ভয়াবহতার তথ্য গোপন করেছিল ফলে মৃত্যু হয়েছিল কোটি মানুষের।
বর্তমানে করোনাভাইরাস নিয়েও বিশ্বনেতারা একই রকম মিথ্যাচার করছেন। ফলে পরিস্থিতি মারাত্মক হয়ে উঠছে। গত ২২ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘এটি আমাদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এটি চীন থেকে আগত এক ব্যক্তির মাধ্যমে এসেছে। এটা ঠিক হয়ে যাবে।’ কিন্তু কিছুই ঠিক হয়নি, এরপর পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়েছে। ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের ১৭৯টি দেশে। ১০ হাজারের অধিক মানুষের মৃত্যু এরই মধ্যে হয়েছে। আরও কতো মানুষের প্রাণ যে কাড়বে করোনা সেটা এই মুহূর্তে কেউ বলতে পারে না।
ইতিহাসবিদ জন এম ব্যারি মনে করেন, ১৯১৮-এর ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির বৃহত্তম শিক্ষাটি হচ্ছে, শুনতে যত বেদনাদায়ক হোক, নেতাদের সত্যটি বলতে হয়। ১৯১৮ সালের মহামারি সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ বইও লিখেছেন ঐতিহাসিক ব্যারি। তিনি সেখানে বলেছেন,১৯১৮ সালে সংকটের ভয়াবহতা সম্পর্কে নেতারা মিথ্যা বলছিলেন, যা সকলের জন্য আরও ভয়, আরও বিচ্ছিন্নতা এবং আরও বেশি যন্ত্রণার সৃষ্টি করেছিল। ব্যারি এই সময়ের ভয়াল মহামারি করোনাভাইরাস নিয়ে ভক্স গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন-
আমরা ১৯১৮ সালের H1N1 (স্প্যনিশ ফ্লু) ভাইরাসের কারণে বিশ্বজুড়ে সৃষ্ট মহামারি থেকে কোন শিক্ষাই গ্রহণ করিনি। প্রাদুর্ভাবের শুরুতে, এটি খারাপ হতে পারে এমন আশঙ্কা ছিল, জীববিজ্ঞানীরা বারবার সতর্ক করার পরও সে সময়ের বিশ্ব নেতারা এটাকে হালকাভাবে নিয়েছিল। ফলে আমরা সে সময় বিপুল প্রাণহানী দেখেছি। কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস যদি তেমন বিপর্যয় সৃষ্টি না করে তবে অবশ্যই আমরা ভাগ্যবান। তবে আমাদের আরও সতর্ক হওয়া দরকার। দায়িত্বশীল হওয়া দরকার।
স্প্যানিশ ফ্লুর সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসকে। তবে দুই ভাইরাসের পার্থক্য হচ্ছে, টার্গেট ডেমোগ্রাফিক। ১৯১৮ সালে মৃত্যুবরণকারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যা ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ছিল। মৃত্যুর দুই-তৃতীয়াংশই মোটামুটি ওই বয়সের মধ্যে ছিল। ১৯১৮ সালে অতিরিক্ত মৃত্যুর ৯০ শতাংশেরও বেশি লোক ৬৫ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এটার টার্গেট ডেমোগ্রাফি বৃদ্ধ ও শারীররিকভাবে দুর্বল ব্যক্তিরা। মৃতদের অধিকাংশেরই বয়স ৬৫ বছরের উপরে।
আর একটি পার্থক্য হল, ইনকিউবেশন রেট। ইনফ্লুয়েঞ্জার গড় ইনকিউবেশন হার ছিল দুই দিন, সর্বোচ্চ চার দিনের বেশি নয়। এর মধ্যেই রোগীর মৃত্যু ঘটেছে। করোনাভাইরাসটির গড় ইনকিউবেশন টাইম প্রায় দ্বিগুণের চেয়ে বেশি। এটি অবশ্যই একটি ভালো দিক। এছাড়া বর্তমানে চিকিৎসা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নত, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন, স্যানিটাইজেশন ইত্যাদির মাধ্যমে করোনাকে প্রতিরোধের চেষ্টা করা হচ্ছে। অনেকাংশে সফলও হচ্ছি। ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির সময় এটা প্রায় অসম্ভব ছিল। করোনার খারাপ জিনিসটি হল এই যে, ভাইরাসটি দীর্ঘ সময় ধরে সার্ভাইভ করতে পারে, এবং আরও বেশি লোককে সংক্রামিত করতে পারে। এটি ইনফ্লুয়েঞ্জার চেয়ে যথেষ্ট সংক্রামক বলে মনে হচ্ছে।
এছাড়া করোনার আরও একটি ইতিবাচক পার্থক্য রয়েছে, এর সংক্রামক ক্ষমতা বেশি থাকা সত্ত্বেও মৃত্যুর হার অনেক কম। ১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জায় পশ্চিমা বিশ্বে মৃত্যুর হার ছিল ২ শতাংশ, তবে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে এটি ছিল অনেক অনেক বেশি। ইনফ্লুয়েঞ্জায় ইরানের পুরো জনসংখ্যার ৭ শতাংশের মতো মারা গিয়েছিল। মেক্সিকোয় মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ মারা গিয়েছিল। এবার করোনার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে ইরানে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। দেশটিতে এরই মধ্যে ১৯ হাজার ৬৪৪ জন আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যু ঘটেছে ১ হাজার ৪৩৩ জনের।
জন এম ব্যারির মতে, ভয়াবহ করোনায় প্রাণহানী ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে চাইলে আমাদের সত্যটা স্বীকার করে নেওয়া উচিত। সঠিক তথ্য জনগণের মাঝে প্রকাশ করা উচিত, যাতে তারা এটার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে সাবধানতা অবলম্বন করতে পারে। প্রকৃত সংক্রমণের সংখ্যা ও নিহতের সংখ্যা স্বচ্ছ্বতার সাথে প্রকাশ করা উচিত। সরকার করোনার সঠিক তথ্য জনগণকে দিচ্ছে না এমন একটা ধারণা সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে এই মহামারি প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
কোভিড-১৯ এর তুলনা শুরু হয়েছে ‘স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা’ মহামারীর সঙ্গে। আজ থেকে ঠিক এক শতক আগের এই মহামারি মানবজাতির সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্করতম, যা পৃথিবী জুড়ে কেড়ে নিয়েছিল ২ থেকে ৫ কোটি মানুষের প্রাণ। ১৯১৮-১৯১৯ সময়ে সারাবিশ্বে ছড়ানো সেই ইনফ্লুয়েঞ্জার উৎপত্তি কোথা থেকে হয়েছিল তা জানা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন জানিয়েছে, ওই ইনফ্লুয়েঞ্জায় মৃত্যু হয়েছিল ৫০ লাখ মানুষের এবং আক্রান্ত হয়েছিল ৫০ কোটি মানুষ। H1N1 ভাইরাসের কারণে ওই ইনফ্লুয়েঞ্জাটি ছড়িয়েছিল। এ ভাইরাসের কারণে ওই সময় শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই প্রাণ হারিয়েছিল ৬ লাখ ৭৫ হাজার মানুষ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও এত মানুষের প্রাণহানি হয়নি। বিশ্ব ইতিহাসে এটিকে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক মহামারি হিসেবে বর্ণনা করা হয়। ১৩৪৭ সালে থেকে ১৩৫১ সময় প্লেগ রোগে চার বছরে যত মানুষ মারা গিয়েছিল ১৯১৮-১৯ ব্যাপী এক বছর ওই ভাইরাসে তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়, ওই ইনফ্লয়েঞ্জা পরিচিতি পেয়েছিল ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ বা লা গ্রিপি নামে। বিশ্বের এক পঞ্চমাংশ মানুষ তাতে আক্রান্ত হয়েছিল।
শতবছর আগের প্রকৃতির এই নিধনযজ্ঞের কেন্দ্রে ছিল ভারতবর্ষ, প্রাণ হারিয়েছিলেন ১ থেকে ২ কোটি মানুষ। দুটি ধাপে ভারতকে গ্রাস করে স্প্যানিশ ফ্লু – প্রথম ধাপে এর প্রভাব ছিল অপেক্ষাকৃত মৃদু, কিন্তু দ্বিতীয় ধাপে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে সারা দেশে আছড়ে পড়ে মহামারি ১৯১৮ সালের শেষ ভাগে। মনে করা হয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরতে থাকা সৈনিকদের হাত ধরেই ভারতে প্রবেশ করেছিল স্প্যানিশ ফ্লু।
এই মহামারির তীব্রতা, বিস্তারের গতি, এবং স্থায়িত্ব অনুমান করতে তৎকালীন ৯টি প্রদেশের ২১৩টি জেলায় সাপ্তাহিক মৃত্যুর পরিসংখ্যান ভিত্তিক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। সেই গবেষণাপত্রের লেখকরা বলছেন, তাঁদের অনুমানের উদ্দেশ্য হলো স্থান- এবং সময়-ভিত্তিক তথ্য ব্যবহার করে ১৯১৮’র মহামারির বিস্তার, মৃত্যুর হার, এবং বিবর্তনের চরিত্র নির্ধারণ করা।
তবে স্প্যানিশ ফ্লুতে ৫ বছরের নিচে, ২০-৪০ বছর বয়সী এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার হার ছিল সবচেয়ে বেশি। ওই ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধে তখন কোনো প্রচলিত চিকিৎসা ছিল না। ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন, ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, জনসমাবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল যা এখন করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও করা হচ্ছে। করোনারও কোন সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি।
মারাত্মক ছোঁয়াচে কোভিড-১৯ ভাইরাসটি নিছক সাধারণ কোন ফ্লু ভাইরাস নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জিনের গঠন বদলে প্রতিনিয়ত এই ভাইরাস নিজের চরিত্রই বদলে ফেলছে এবং আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। এত বেশি নিজেকে বদলাচ্ছে এই ভাইরাস যে এর মতিগতি বোঝাই অসম্ভব হয় পড়ছে বিশ্বের বাঘা বাঘা ভাইরোলজিস্টদের কাছে।