রুমিন ফারহানা: নানা মন্তব্য তাকে নিয়ে। নানা আলোচনা-সমালোচনা। সবই অবশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। রোগতত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক। অক্সফোর্ডের ছাত্রী ছিলেন। বিশ্বমহামারির এই কঠিন সময় যখন দেশের গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিলেন তিনি ঠিক তখনই প্রশ্ন কেন তাকে নিয়ে? মানুষের মনস্তত্ব বড় অদ্ভুত। অবশ্য অসহায় মানুষের আর কিই বা করার আছে।
৮ই মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে, এরপর ১৮ই মার্চ প্রথম ব্যক্তির মৃত্যুর কথা জানায় আইইডিসিআর। প্রায় ১ মাস পর লেখাটি যখন লিখছি তখন বাংলাদেশে কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি ঘোষণা মতে ৫৪ জন। আর মৃতের সংখ্যা ৬ জন। অর্থাৎ সরকারি ঘোষণা মতেই শতকরা হিসাবে এই হার ১১.১১%, যেখানে বিশ্বে মৃতের শতকরা হিসাব ৪% এর আশপাশে। করোনা শুরুর সময় পর্যাপ্ত পরীক্ষার অভাব, বিদেশ ফেরত না হলে কিংবা বিদেশ ফেরত কারও সংস্পর্শে না এলে পরীক্ষা না করা, অথচ বিদেশ ফেরত সাড়ে ৬ লাখের মধ্যে মাত্র ১৭ হাজার মানুষকে কোয়ারেন্টিনে নেয়া, বাকিদের কোন খোঁজ না রাখা এবং সর্বোপরি মিরপুরের দ্বিতীয় ব্যক্তি’র মৃত্যুর পর আইইডিসিআর এর পক্ষে ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা এক প্রকার বাধ্য হয়েই যেন স্বীকার করলেন সীমিত আকারে হলেও দেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হচ্ছে।
এবার বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রগুলোর অবস্থা একটু দেখে নেয়া যাক। ২০৩টি দেশে এর মধ্যেই অসুখটি ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বমোট আক্রান্তের সংখ্যা ৮,৭৪,৬১৫ জন, মৃত ৪৩৪৩০ জন অর্থাৎ গড়ে শতকরা হিসাবে ৪.৯%। সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয়েছে আমেরিকায়। সেখানে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১,৮৮,৬৩৯ জন, মৃত ৪০৫৯ জন। আশংকা করা হচ্ছে মৃতের সংখ্যা ২ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। এর পরেই ইতালির অবস্থান। সেখানে মোট আক্রান্ত ১০৫৭৯২ জন আর মৃত্যু বরণ করেছেন ১২৪২৮ জন। তৃতীয় অবস্থানে আছে স্পেন। সেখানে মোট আক্রান্ত ১০২১৩৬ জন আর মৃত্যু বরণ করেছেন ৯০৫৩ জন। আর বাংলাদেশে মার্চ মাসে শ্বাসতন্ত্রে আক্রান্ত রোগী ১৪ গুন বাড়লেও করোনা আক্রান্তের সংখ্যা সীমিত। এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে অবশ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রী অতি বিরক্তির সাথে পাল্টা প্রশ্ন করেন কেন রোগীর সংখ্যা বেশি হলে কি আপনারা খুশি হতেন? যৌক্তিক প্রশ্ন বটে। তবে কথা হল রোগীর সংখ্যা কম হলে মানুষ খুশি হতো তখনি যখন সে বিশ্বাস করতো সরকারের বয়ান।
কিন্তু আস্থা আর বিশ্বাসের তীব্র সংকটে ভুগছে মানুষ। সে সংকট আরও বেশি ঘণিভূত হয়েছে সরকারের জারি করা এক পরিপত্রের পরে। গত ২৪ মার্চ জারি করা সেই পরিপত্রে বলা হয় বেসরকারি টিভি চ্যানেলসমূহে সম্প্রচারিত করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বিষয়ে অপপ্রচার কিংবা গুজব প্রচার করা হচ্ছে কিনা তা মনিটরিং করার জন্য উপসচিব ও সহকারী সচিব পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যদিও পরিপত্রটি পরে বাতিল করা হয় কিন্তু ক্ষতি যা হবার তা ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রে সাংবাদিকরা কখনই নিরাপদ নয়। নানা রকম প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে তাদের পথ চলতে হয়। যেখানে পুরো বিশ্ব থমকে গেছে এই মহামারিতে, বাড়ি বন্দি মানুষের চোখ আটকে আছে টিভি’র পর্দায়, শুধু দেশ না বিদেশ বিভূইয়ে থাকা স্বজনের চিন্তায় কাটছে নির্ঘুম রাত সেখানে হঠাৎ এ ধরনের পরিপত্র মানুষের মনে সন্দেহ জাগায় বৈকি।
কি লুকাতে চাওয়া হচ্ছে? বিশ্বায়নের এই যুগে মূলধারার গণমাধ্যম কি করে করবে অপপ্রচার? ভয়, আতংক কিংবা লোভ যাই হোক না কেন তার বশে পরে অনেক গণমাধ্যমই যখন সেলফ সেন্সরশিপের চর্চায় ব্যস্ত তখন কেন এত ভীতি? সাধারণ মানুষ যারা নিয়মিত দেশি বিদেশি গণমাধ্যমের দিকে চোখ রাখেন তারা অবশ্য বলছেন যে দেশে পরীক্ষাই হচ্ছে না যথাযথ ভাবে সেখানে রোগী ধরা পড়বে কি করে? শুরু থেকে পরীক্ষার একচ্ছত্র মালিক ছিল আইইডিসিআর, সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। সুতরাং অনেকেই বলছেন এটি সরকারের মুখপাত্রের বেশি কোন ভূমিকা রাখার ক্ষমতাই রাখেনা। সেখান থেকে কিছু নম্বর দেয়া হলেও অভিযোগ আছে জরুরি প্রয়োজনে ৩/৪ ঘন্টা চেষ্টার পরও অনেক সময়ই রেসপন্স পাওয়া যায়নি।
অনুন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, ঘনবসতি, মানুষের মধ্যে শিক্ষা, সচেতনতার অভাব, পরিচ্ছনতা বোধ কম থাকা স্বত্বেও বাংলাদেশে রোগী সংখ্যা এত কম হবার কারণ হিসাবে ঢাকা ট্রিবিউনের রিপোর্ট বলছে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস পরীক্ষার হার বিশ্বে সর্বনিম্ন। আইইডিসিআর এর তথ্য অনুযায়ী গড়ে প্রায় ১ লাখ ৪৯৯ জনের মধ্যে সন্দেহভাজন আক্রান্ত হিসাবে একজনকে টেস্ট করা হচ্ছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করে বলেছেন পর্যাপ্ত টেস্ট না করা হলে এই মহামারি বন্ধ করা সম্ভব হবে না। কারণ টেস্ট না করা হলে অবস্থার আসল চিত্র উঠে আসবে না। যেখানে বাংলাদেশ লাখে মাত্র ১ জনের টেস্ট করছে, সেখানে অন্যান্য দেশে এই অনুপাত অনেক গুন বেশি। কোনো কোনো দেশে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে এক হাজার জনকে টেস্ট করা হচ্ছে। নানা প্রশ্ন আছে মানুষের মনে। আছে ভয়, শঙ্কা, অসহায়তা।
এই মহা দুর্যোগে সবচেয়ে বড় নির্ভরতার জায়গা হবার কথা ছিল সরকার। বিশ্বাস আর আস্থা থাকার কথা ছিল সরকারের উপর। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য সেই বিশ্বাস, আস্থা আর নির্ভরতা দেশের মানুষ সরকারের মধ্যে পায়নি। পাবার কথাও না। যেহেতু এটি মহা দুর্যোগ এবং বিশ্বের কোন দেশই আজ নিরাপদ নয় তাই একটাই উপায় ছিল সরকারের হাতে মানুষের আস্থা অর্জনে; আর তা হলো সততা, স্বচ্ছতার সাথে সকল তথ্য মানুষের কাছে তুলে ধরা। সরকারের সক্ষমতার সীমাবধ্যতা থাকতে পারে, থাকতে পারে ব্যর্থতাও। কিন্তু কোন সীমাবধ্যতাই ততটা ক্ষতি করবে না, যতটা ক্ষতি করবে তথ্য গোপন করা। যেখানে এক মুহূর্ত সমান হাজার মানুষের জীবন সেখানে তথ্য গোপনের পরিনাম কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু সরকার কি তা ভাবছে?