ভয়কে জয়: হাসপাতাল বিমুখ মানুষ পুলিশ, সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর দিকে!

Slider জাতীয় ফুলজান বিবির বাংলা বাংলার মুখোমুখি লাইফস্টাইল


রিপন আনসারী: অসুস্থ হলে মানুষ হাসপাতালে যায়। নিরাপত্তার সমস্যা হলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে যায়। দেশ ও দেশের মানুষ বড় বিপদে পড়লে সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর কাছে যায়। কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে ভিন্ন রকম চিত্র। বিশ্ব মহামারীতে মানুষ হাসপাতালের স্বরণাপন্ন না হয়ে পুলিশের কাছে যাচ্ছে। পুলিশের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ঘরে থাকার নির্দেশ অমান্য করে বাইরে যাওয়ার ঘটনায় আইন মানতে মানুষ সেনাবাহিনীর কথা শুনছে বেশী। কারণ কি? এই পর্যন্ত সেনাবাহিনীর হাতে কোন নাগরিক অপমানিত হয়নি। পুলিশের হাতে অপমানিতও হয়েছে, আবার সম্মানও পেয়েছে। কতিপয় সিভিল কর্মকর্তার প্রতিও এবার মানুষ বিরক্ত হয়েছেন। তারা অমানবিক কাজ করেছেন। অবশ্য শাস্তিও পেয়েছেন। তবে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের চেয়ে এবার মানবিক আচরণের দৃষ্টান্ত আগে থেকে বেড়েছে। এর কারণ আভ্যন্তরীর চাপ বা সবাই আক্রান্ত হতে পারেন তাই পাশে দাঁড়ানো উচিত, এমনটিও হতে পারে বা পুরোটাই মানবিক হতে পারে।

যাই হউক, পুলিশ ও সেনাবাহিনী আসলেই মানুষের জন্য কাজ করে এবার তা আবারো প্রমান হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক সংবাদ হল,সেবাকর্মীদের প্রতি মানুষ অসস্তুষ্ট হচ্ছে কেন? এ ক্ষেত্রে যদি চিকিৎসা কর্মীদের বক্তব্যই বলি যে. তাদেরও জীবনের নিরাপত্তা দরকার। অবশ্যই দরকার। কেন নয়। আত্মরক্ষা করে সেবা করতে হবে এটাই তো কথা। কিন্তু মৃত্যুর ভয়ে ঘরে চলে যেতে হবে তবে বা আত্মরক্ষার জন্য সঙ্গহীন হতে হবে এমনটা হল ফাঁকিবাজী। কারণ যারা দেশের সেবা করেন, তারা দেশ সেবা করতে গিয়ে মারা গেলে শহীদ হন। যদি কেউ সরকারী চাকুরী বা সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত থাকেন, তবে অবশ্যই তিনি জেনে শুনে যান যে, তাকে শহীদও হওয়া লাগতে পারে। দেশের ও মানুষের সেবা করতে গিয়ে পুলিশ, সেনাবাহিনী সহ সশস্ত্র বাহিনীর অনেক সদস্য শহীদ হচ্ছেন। অনেক সাংবাদিকও শহীদ হচ্ছেন। এমনকি যার ডাকে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তিনিও শহীদ হয়েছেন দেশ সেবা করতে গিয়েই। তাই সরকারী ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শহীদ হওয়ার ভয়ে পালিয়ে যাওয়া কোন দেশপ্রেমিক ও সেবাকর্মীর কাজ নয়। এমনটা হয়ে থাকলে আমাদের সংশোধন হওয়া দরকার। এ ছাড়াও বিশ্ববাসী যা কোন দিন দেখেনি, তাও তো এখন দেখছে। অজানা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষ মরছে। মত্যুর মিছিল বাড়ছে। আজ যিনি দায়িত্ব ফাঁকি দিয়ে পালাচ্ছেন, তিনিও তো এই মিছিলে আসতে পারতেন বা পারতে হতে পারে। সুতরাং দায়িত্ব ফাঁকি না দিয়ে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে শহীদ হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। না হয় শেষ রক্ষা কঠিন হবে।

সাধারণ মানুষ বলছে, সরকারী বেসরকারী হাসপাতালের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও পুলিশ তথা সশস্ত্র বাহিনী নিয়ন্ত্রিত হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা করলে মানুষ আরো ভরসা পাবে। কারণ সেনাবাহিনী, পুলিশ র‌্যাব তথা সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা সাধারণ মানুষ বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘরে রাখছে। তারা যথাযথ সম্মান দিয়ে নাগরিকদের সেবা করছেন। কিন্তু ডাক্তাররাও তো মানুষের জীবন রক্ষার চেষ্টা করতেন, করছেন, করবেন। তবে এখন মানুষ কেন তাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইছেন? মানবসেবা পরম ধর্ম এবং আইন এবং সংবিধান। তাই জেনে শুনে চাকুরীতে এসে না জানার মত করে দায়িত্ব পালন করলে মানুষ তো মুখ ফিরিয়ে নিতেই চাইবে। তাই এখনো সময় আছে আসল জায়গায় অবস্থান করা বা ফিরে আসা।

তথ্য রয়েছে, জ্বর, সর্দি, কাশি ও গলা ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে না গিয়ে অসংখ্য মানুষ পুলিশমুখী হচ্ছে। হাসপাতালে গিয়ে হয়রানির শিকার হবেন—এই আশঙ্কায় অনেকেই পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছেন। এই সংক্রান্ত সহযোগিতা নেওয়ার জন্য থানা পুলিশের পাশাপাশি পুলিশ নিয়ন্ত্রিত জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এ প্রতিদিন মানুষ ফোন দিচ্ছে। জাতীয় জরুরি সেবার কর্মীরাও মানুষকে সাধ্যমত সহযোগিতা করছেন।

জাতীয় জরুরি সেবার পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ১৮ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত রাজধানীসহ সারাদেশ থেকে ৮১ হাজার ৭৫৯টি কল এসেছে। এর মধ্যে করোনা চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য নিয়েছেন ৭৬ হাজার ২৪২ জন কলার। ৫ হাজার ৫১৭ জন পুলিশের কাছ থেকে মাঠ পর্যায়ে সেবা নিয়েছেন।

গত ৩১ মার্চ টঙ্গী থেকে এক আইনজীবী ফোন করে ৯৯৯ এ জানান, মোহাম্মদপুরে তার মামী মারা গেছেন, তার শরীরে করোনার সব উপসর্গ ছিল। এ বিষয়ে তারা কোথায় যোগাযোগ করে নমুনা পরীক্ষা করাতে দিতে পারেন সে পরামর্শ চান তিনি। জাতীয় জরুরি সেবা থেকে তখন ওই ব্যক্তিকে মোহাম্মদপুর থানায় সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ আইইডিসিআর থেকে নমুনা সংগ্রাহকদের নিয়ে এসে ওই নারীর নমুনা সংগ্রহ করান। যার ফলাফল এখনও পাওয়া যায়নি। তবে পরিবারটি কোয়ারিন্টেনে থাকার অনুরোধ করা হয়েছে।

জাতীয় জরুরি সেবা থেকে জানানো হয়, করোনাভাইরাস সংক্রমণ হওয়ার পর ৯৯৯ এ গড়ে ৫ থেকে ৬ হাজার কল বেড়েছে। বেশিরভাগ মানুষ করোনাভাইরাসের উপসর্গ, চিকিৎসা, নিকটস্থ হাসপাতালে কোথায় চিকিৎসা হয়, অ্যাম্বুলেন্স সেবা, হোম কোয়ারেন্টিনে কতদিন থাকতে হবে এবং নিত্যপণ্য চেয়েছে। জাতীয় জরুরি সেবা এসব বিষয়ে মানুষকে তথ্য সরবরাহ করছে। পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে যেসব পুলিশ সদস্যকে গিয়ে নাগরিকদের সেবা দিতে হবে সেখানে পুলিশ পাঠানো হচ্ছে।
৩০ মার্চ কুমিল্লা থেকে এক কলার জাতীয় জরুরি সেবায় ফোন দিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে এক ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্সের সহযোগিতা চান। ৯৯৯ একটি অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে দেন। তবে এজন্য বেগ পেতে হয়েছে জাতীয় জরুরি সেবার কর্মীদের। কারণ সন্দেহভাজন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের অ্যাম্বুলেন্স তুলতে চান না চালকরা। অনেকে নিতে চাইলেও যথাযথ পিঁপিঁই না থাকায় সার্ভিস দিতে পারছেন না বলে জানান জাতীয় জরুরি সেবার পুলিশ কর্মকর্তারা।

জাতীয় জরুরি সেবার তথ্যানুযায়ী গত ১৮ মার্চ ৯৯৯ এ করোনা সংক্রান্ত কল এসেছে ৪ হাজার ২১টি। তাদের মধ্যে তথ্য নিয়েছেন ৩৭ শ’ কলার। পুলিশের কাছ থেকে সরাসরি সহযোগিতা নিয়েছেন ৩২১ জন। ১৯ মার্চ করোনাভাইরাস সংক্রান্ত ৪ হাজার ২৬৫টি কল এসেছে। এর মধ্যে তথ্য নিয়েছেন ৩ হাজার ৯৩৮ জন কলার এবং পুলিশের সহযোগিতায় চিকিৎসা সংক্রান্ত সহযোগিতা নিয়েছেন ৩২৭ জন। ২০ মার্চ সারাদেশ থেকে কল এসেছে ৫ হাজার ৩৯১টি। ৪ হাজার ৭৭৫ জন তথ্য নিয়েছেন এবং সহযোগিতা নিয়েছেন ৬৪৬ জন। ২১ মার্চ ৫ হাজার ৬৭৭ টি কল আসে। বিভিন্ন থানা পুলিশের সরাসরি সহযোগিতা নিয়েছেন ৭৪৫ জন। তথ্যসেবা নিয়েছেন ৪ হাজার ৯৩২ জন। ২২ মার্চ সেবা নিয়েছেন ৬ হাজার ৪ জন, ২৩ মার্চ সেবা নিয়েছেন ৬ হাজার ৩৮৬ জন, ২৪ মার্চ সেবা নিয়েছেন ৬ হাজার ৫৫৫ জন, ২৫ মার্চ ৬ হাজার ৮২১ জন, ২৬ মার্চ ৭ হাজার ৬৫৭ জন, ২৭ মার্চ ৬ হাজার ৫৬১ জন, ২৮ মার্চ সেবা নিয়েছেন ৬ হাজার ৭১৬ জন, ২৯ মার্চ ৬ হাজার ১০৬ জন, ৩০ মার্চ ৬ হাজার ১৯৯ জন এবং ৩১ মার্চ সারাদিন সারাদেশ থেকে ৭ হাজার ৪২১ জন কলার কল দিয়ে সেবা নিয়েছেন।

জ্বর-সর্দি নিয়ে মানুষ বর্তমানে আতঙ্কিত। অনেকেই ঘরে বসে সাধারণ প্যারাসিটামল খেয়ে নিচ্ছেন। আবার অনেকে আতঙ্কিত হয়ে বিষয়গুলো কারও সঙ্গে শেয়ার করছেন না। বেসরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারও বন্ধ। মানুষের জ্বর সর্দি ও গলা ব্যথা নিয়ে চিকিৎসকদের পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ কম। বেসরকারি হাসপাতালে জ্বর, সর্দি নিয়ে কাউকে ঢুকতেই দেওয়া হচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালগুলোতেও পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ জ্বর সর্দি ও কাশি নিয়ে একাধিক হাসপাতালে ঘুরছে এমন নজিরও রয়েছে। তাই মানুষ বাধ্য হয়ে ৯৯৯ এ ফোন দিয়ে পুলিশের সহযোগিতা নিচ্ছেন। অনেকে খাবারের কথা বলছেন। এক্ষেত্রেও প্রয়োজন অনুযায়ী সেবা দিচ্ছে পুলিশ।

জাতীয় জরুরি সেবা থেকে সেবা নিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন এক ব্যক্তি বলেন, ‘পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে হাসপাতালে গেলে চিকিৎসা এবং অ্যাম্বুলেন্স চেয়ে পেয়েছি। আমার রোগীর জ্বর থাকায় তাকে অ্যাম্বুলেন্সেই তুলতে চাইছিল না। পরে ৯৯৯ এর সহযোগিতায় অ্যাম্বুলেন্স পেয়েছি। রোগীকে হাসপাতালও ভর্তি করেছে। পুলিশের সহযোগিতায় সব সহজ হয়েছে।’

টিঅ্যান্ডআইএম বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ জানান, মানুষ করোনা সংক্রান্ত তথ্য নিচ্ছেন। কোথায় কিভাবে চিকিৎসা পাওয়া যাবে তা জানছেন। যে যা জানতে চাচ্ছে, যে সহযোগিতা চাচ্ছেন তা করা হচ্ছে।

করোনভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে গত ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি চলছে। মানুষ প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছে না। আইইডিসিআর’র তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত দেশে ৫৪ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ছয়জন এবং সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ২৬ জন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *